• সোমবার, ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ১২:১৮ অপরাহ্ন

স্বাধীনতার ৪৯ বছর পেরিয়ে গেলেও মুক্তিযোদ্ধার সনদ পাননি মুক্তিযুদ্ধা রশিদ

আপডেটঃ : মঙ্গলবার, ৭ জুলাই, ২০২০

 

জিসান আহমেদ নান্নু, কচুয়া ॥
দেশের জন্য জীবন বাজি রেখে যে মানুষটি দেশ স্বাধীন করেছেন। দেশের স্বাধীন পতাকা এনে দিয়েছেন সেই মানুষটি সনদ মেলেনি দীর্ঘ ৫০ বছরেও। মহান স্বাধীনতার সুদীর্ঘ প্রায় ৫০ বছর অতিক্রম করলেও এমএ রশিদ প্রধানের মুক্তিযুদ্ধের সনদ মেলেনি। ফলে তার পরিবার ও স্থানীয়দের মাঝে চরম ক্ষোভ ও হতাশা দেখা দিয়েছে।
পেছনের কথা :
এম.এ রশিদ প্রধান চাঁদপুর জেলাধীন কচুয়া উপজেলার ৯নং কড়ইয়া ইউনিয়নের শ্রীরামপুর গ্রামের প্রধানীয় বংশের এক সম্ভান্ত পরিবারে জন্ম গ্রহন করেন। তাঁর প্রয়াত পিতা আমিরুদ্দিন প্রধান ও মাতা উলফতের নেছা। তিনি ১৯৪৩ সালের ১০ মার্চ জন্ম গ্রহন করেন এবং ২০১৮ সালের ১৭ মার্চ মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর জৈষ্ঠ্য সন্তান বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও তরুন সমাজ সেবক মো. নাছির উদ্দিন প্রধান। তিনি বর্তমানে চট্রগ্রাম শহরে মা ও ভাই-বোন নিয়ে বসবাস করছেন।
শিক্ষাজীবন ও পদ পদবী:
এম.এ রশিদ প্রধান ১৯৬০ সালে এসএসসি পরীক্ষায় পাসের পর চট্টগ্রাম সরকারি কলেজে ভর্তি হন। ওই বছর তিনি কলেজের ক্যাবিনেট নির্বাচনে ছাত্রলীগের সমাজকল্যান সম্পাদক পদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৫ সালে বিরোধী দলের একজন ত্যাগী কর্মী হিসেবে তথাকথিত পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট পদ প্রার্থী ফাতেমাজিন্নার নির্বাচন করেন। ১৯৬৬ সালে ৬দফা আন্দোলনে অংশগ্রহন করেন। ১৯৬৯ সালে আওয়ামী লীগের একজন নিবেদিত কর্মী হিসেবে গণআন্দোলনে অংশগ্রহন করে কচুয়া থানার বিভিন্ন ইউনিয়ন ও থানা আওয়ামীলীগকে সু-সংগঠিত করেন এবং থানা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ পদে নির্বাচিত হন। একই বছরে বুরগী জুনিয়র স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সম্পাদক পদে দায়িত্ব পালন ও ১৯৭০ সালে বুরগী হাই স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭০ সালে প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে কচুয়া থানা আওয়ামী লীগ নির্বাচন কমিটির সভাপতি, কচুয়া ও বরুড়া থানায় জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামীলীগ নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১ সালে ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পাকিস্তান বিরোধী অসযোগ আন্দোলন ডাক দেয়ার পর তৎকালীন সময়ে তিনি কচুয়া থানা আওয়ামী লীগ সংগ্রাম কমিটির সভাপতি ও মুক্তিযোদ্ধা চলাকালীন সময়ে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭১ সালের ১৬ই জুন এম.এ রশিদ প্রধান মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহনের জন্য ভারতের আগরতলা যান। সেখানে প্রথমে কাঠালিয়া ও পরে বড়মূড়া ইউথ ক্যাম্প ও অন্যান্য ক্যাম্প হইতে কচুয়া থানার অন্যান্যদের নির্বাচিত করে মতলবের ফ্লাইট লেফ: এবি সিদ্দিক ও চট্টগ্রামের প্রফেসর মো: নুরুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করেন। ১৯৭১ সালে ৬ আগষ্ট আগরতলা দূর্গা চৌধুরীপাড়া মিলিটারী হোল্ডিং ক্যাম্পের মুভিলাইজার কাম লিয়াজন অফিসার হিসেবে বাংলাদেশ সরকারের নিয়োগপত্র পান এবং দায়িত্বপালন করেন।
১৮ই অক্টোবর হোল্ডিং ক্যাম্পের ডেপুটি ক্যাম্প চীফের পদে মুজির নগর সরকারের তরফ হতে তাকে দায়িত্ব দেয়া হয়। দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত তিনি দায়িত্ব পালন করেন। ১৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশপ্রাপ্ত হয়ে ১৭ ডিসেম্বর তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং দেশের পূর্নগঠনের কাজে নিয়োজিত হন। থানা প্রশাসন পূন:স্থাপিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত থানার শান্তি-শৃঙ্খলা ও প্রশাসনের কাজে নিয়োজিত ছিলেন।
১৯৭২ সালে কচুয়া বঙ্গবন্ধু কলেজের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে তিনি একজন নির্বাচিত হন। পাশাপাশি কলেজের কোষাধ্যক্ষ ও গভর্নিংবডির সদস্য হন এবং কলেজটি বঙ্গবন্ধুর নামে নামকরণের প্রস্তাবক ছিলেন। একই বছরে চাঁদপুর মহকুমা রিলিফ কমিটির থানা সদস্য ও কড়ইয়া ইউনিয়ন রিলিফ কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। ১৯৮০ সালে তিনি নিজ গ্রামে শ্রীরামপুর মোহাম্মদিয়া ইসলামিয়া সিনিয়র মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৮৬ সালে এম.এ রশিদ প্রধানের প্রচেষ্টায় কচুয়া সরকারী পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় ও কচুয়া শহীদ স্মৃতি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় সরকারী করন করা হয়। ১৯৮৮-১৯৯০ সাল পর্যন্ত তিনি চাঁদপুর জেলা পরিষদের সদস্য ছিলেন। ১৯৯৭-১৯৯৯ সাল পর্যন্ত তিনি চট্রগ্রামস্থ চাঁদপুর সমিতির সভাপতি ছিলেন।
এহান মুক্তিযুদ্ধের এ অন্যতম সংগঠক বীর মুক্তিযোদ্ধা এম.এ রশিদ প্রধান মুক্তিযুদ্ধা তালিকা ভূক্ত হওয়ার জন্য এবং মুক্তিযুদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের সাময়িক সনদ পাওয়ার সকল প্রক্রিয়ায় অংগ্রহন করেন।
কচুয়ায় নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক মুক্তিযোদ্ধারা ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, মন্ত্রনালয়ের নানা মূখী বিতর্কিত সিন্ধান্ত ও প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাচাই নিয়ে বহু বছর টালবাহানার কারনে জীবিত থাকা অবস্থায় তাহার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি মিলেনি। সর্বশেষ জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের ঘোষিত ২০১৫ সালে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের অনলাইনে আবেদন করেন। সে আবেদনের প্রেক্ষিতে ২০১৭ সালে চাঁদপুরের কচুয়া উপজেলার ৭ সদস্য বিশিষ্ট যাছাই বাছাই কমিটি কর্তৃক তিনি মুক্তিযোদ্ধা নির্বাচিত হন। ৭ সদস্য বিশিষ্ট যাচাই বাচাই কমিটি কর্তৃক স্বাক্ষরিত জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে প্রেরিত তালিকার অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধার নামের সাথে এম.এ রশিদ প্রধানের নামের ক্রমিক নং ২২। যাহা পর পর ২ বার যাচাই-বাচাই কমিটি কর্তৃক হাতে হাতে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলে পৌছানো হয় এবং রিসিভ কপির মাধ্যমে জমা দেয়া হয়। তাঁরা আরো বলেন, মন্ত্রনালয় ও মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের বির্তকিত সিদ্ধান্ত, অনিয়ম ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের গাফিলতিতে বৃদ্ধ বয়সে বহু মুক্তিযুদ্ধার ভোগান্তির শেষ নেই। জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের হিমাগারে বন্দি মুক্তিযুদ্ধা তালিতা কবে নাগাদ আলোর মুখ দেখবে? মরহুম এম.এ রশিদ প্রধানের মতো আলোকিত সক্রিয় মুক্তিযোদ্ধরা কবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাবে?
বীর মুক্তিযোদ্ধা আনোয়ার হোসেন সিকদার জানান, প্রয়াত এম.এ রশিদ ঠিকাদার একজন সৎ ও নীতিবান মানুষ ছিলেন। তৎকালীন সময়ে তিনি কচুয়ার অনেক উন্নয়ন বাস্তবায়ন করেছেন। জীবনে তিনি কখনো অন্যায়ের সাথে আপোষ করেনি। এমন মানুষ বর্তমান সময়ে পাওয়া বিরল। তাঁর মুক্তিযোদ্ধার সনদ না পাওয়ার বিষয়টি খুবই বেদনাদায়ক।
কচুয়া উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ডেপুটি কমান্ডার আলহাজ¦ মো. জাবের মিয়া বলেন, মরহুম এম.এ রশিদ প্রধান একজন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সক্রিয় সংগঠক। আমরা তাঁকে প্রথম দিকে মুক্তিযুদ্ধের সনদ নিতে আহ্বান করি, তিনি রাজি হননি। পরবর্তীতে আমরা উপজেলা যাচাই বাচাই কমিটি তাঁর নাম মন্ত্রনালয়ে প্রেরণ করি। কিন্তু এখনো মন্ত্রনালয় থেকে কোন সিদ্ধান্ত আসেনি।
এদিকে কচুয়া উপজেলার শ্রীরামপুর গ্রামের বীর সন্তান ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক প্রয়াত এম.এ রশিদ প্রধানের মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নকে বাস্তবায়নের জন্য দ্রুত তাঁকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন এলাকাবাসী।


এই ক্যাটাগরির আরো নিউজ

ফেসবুকে মানব খবর…