সাইদ হোসেন অপু : চাঁদপুরের চরাঞ্চলসমৃদ্ধ ও ১৪ টি ইউনিয়ন ও পৌরসভার মতলব উত্তর উপজেলায় গত ২ বছরে স্কুল পড়ুয়া ১২ শতাধিক মেয়ে বাল্য বিয়ের শিকার হয়েছে। এ উপজেলায় আশঙ্কাজনক হারে বাল্য বিয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। উপজেলা প্রশাসন ও উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসে কোনো ধরনের তথ্য না থাকলেও অনুসন্ধানে এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে।
এ উপজেলা মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ৫১টি। এর মধ্যে ৩৯টি উচ্চ বিদ্যালয় এবং ১২টি মাদ্রাসা। মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়ুয়া মেয়েদের বিয়ে হওয়ার পর বেশিরভাগ মেয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ঝরে পরে। বাল্যবিয়ের শিকার খুব সামান্য সংখ্যক মেয়েই লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়ার সুযোগ পায়।
মতলব উত্তর উপজেলার স্কুলগুলো বাল্যবিয়ের ব্যাপারে তথ্য দিতে না চাইলেও বিভিন্নভাবে অনুসন্ধান চালিয়ে দেখা গেছে উপরোক্ত তথ্যের সত্যতা। গত দু বছরে এ উপজেলার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে পড়ুয়া কি পরিমান মেয়ে বাল্য বিয়ের শিকার হয়েছে তার চিত্রটা হলো, শরীফ উল্যাহ উচ্চ বিদ্যালয়, এখলাছপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও কালিপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রতিটি স্কুলে ৩০টি করে বাল্য বিয়ের খবর পাওয়া যায়।
এর মধ্যে জমিলা খাতুন উচ্চ বিদ্যালয়ে ২৬টি, নেদায়ে ইসলাম মহিলা মাদ্রাসা ও বদরপুর আকবর আলী খান উচ্চ বিদ্যালয়ে ২৪টি করে, চরকালিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে ২২টি, নাউরী উচ্চ বিদ্যালয় ও বাগানবাড়ী আইডিয়েল একাডেমীতে ২০ টি করে, গাজীপুর কেএএল উচ্চ বিদ্যালয় ১৫টি বাল্য বিয়ে হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
শিক্ষকরা বাল্যবিয়ের ব্যাপারে সঠিক তথ্য দিতে না চাইলেও উপজেলার ১০টি স্কুলের শিক্ষকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাদের স্কুলে গত ২বছরে বাল্য বিয়ের সংখ্যা ২৪১টি। সে হিসেব অনুযায়ী উপজেলার ৩৮টি উচ্চ বিদ্যালয় ও ১২টি মাদ্রাসাতে বাল্যবিয়ের সংখ্যা দাঁড়ায় ১২শ ২৯টির মতো। তবে শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনা করে এ তথ্য দেয়া হলেও বিভিন্ন তথ্য মতে বাস্তবে বাল্য বিয়ের সংখ্যা আরো বেশি।
স্কুল পড়ুয়া মেয়েদের মধ্যেই যদি বাল্য বিয়ের সংখ্য এতো হয়ে থাকে তবে ১ পৌরসভা ও ১৪ ইউনিয়নের এ উপজেলার বেশ কটি চর, কয়েকটি আশ্রয়ন প্রকল্প, একাধিক গুচ্ছগ্রাম ও বেড়িবাঁধে আশ্রয় নেওয়া মানুষগুলোর মধ্যে অনেকেরই সচেতনতার অভাব ও শিক্ষা পশ্চাৎপদতার কারণে সেখানে বাল্য বিয়ের সংখ্যা আরো বেশী বই কম হবে না।
বিভিন্নভাবে খোঁজ খবরের ভিত্তিতে বাল্যবিয়েতে পুলিশের হানা, মোবাইল কোর্ট পরিচালনা, বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সচেনতামূলক সভা, বাল্যবিয়ে বিরোধী শপথবাক্য পাঠসহ নানা কার্যক্রমই হচ্ছে এ উপজেলায়। এতদসত্বেও গত ২বছরে এ উপজেলায় ১২শতাধিক বাল্যবিয়ে সংগঠিত হওয়ার বিষয়টি সত্যিই উদ্বেগ জনক।
উপজেলার চরকালিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের করনিক জানান, গত বছর ৮ম শ্রেণির জেএসসি রেজিস্ট্রেশন করার সময় ৬জন মেয়ে যখন রেজিস্ট্রেশন করতে আসেনি। তখন খবর নিয়ে জানা গেছে ঐ মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে। ওরা এখন ঘর সংসার করছে। শ্বশুর বাড়ির লোকজন ওদের আর লেখাপড়া করাবে না।
নকল বা মিথ্যে তথ্যেও জন্ম নিবন্ধনের মাধ্যমে এসব বিয়েগুলো রেজিস্ট্রেশন হয়ে থাকে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পাস্পরিক সমন্বয়ের ভিত্তিতে বিয়ে হয়ে যায়। কিন্তু বিয়ে রেজিস্ট্রি বাকি থাকে। এখানকার বাল্য বিয়েগুলোর বেশিরভাগই অভিভাবকদের অসচেতনতার কারণে হয়ে আসছে। কিন্তু মতলব উত্তর উপজেলায় সচেতনতামূলক সভা ও বাল্যবিয়েবিরোধী শপথবাক্য যা হচ্ছে তা বেশীরভাগ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের সঙ্গেই হচ্ছে।
অভিভাবকদের সঙ্গে এ ধরনের কার্যক্রম হচ্ছে যতসামান্য। বাল্য বিয়ের ব্যপারে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার আব্দুল কাইয়ূম খান জানান, ‘উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসে বাল্য বিয়ে সংক্রান্ত কোন তথ্য নেই বা বাল্য বিয়ের বিষয়ে কোন তথ্য আমাদের সংগ্রহ করতে হয় না। এ ব্যাপারে মতলব উত্তর উপজেলা নির্বাহী অফিসারের দপ্তরে যোগাযোগকালে তারা জানায়, ‘এ উপজেলার মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কি পরিমাণ শিক্ষার্থী বাল্যবিয়ের শিকার সে ধরণের কোন তথ্য আমাদের দপ্তরে নেই।’
মতলব উত্তর উপজেলা নির্বাহী অফিসার শারমিন আক্তার বলেন, ‘যেখানেই বাল্য বিয়ে প্রস্তুতির খবর পাই সেখানেই ছুটে যাই। হোক সেটা দিন কিংবা গভীর রাত। বাল্য বিয়ে সাধারণত রাতের বেলাতেই আয়োজন হয়ে থাকে। তবে আমি অবাক হই যখন দেখি গেইট বানিয়ে দিনের বেলায় ঝাকঝমকভাবে বাল্য বিয়ের আয়োজন করে। আমি গত এক বছরে নিজে গিয়ে, জনপ্রতিনিধি ও অন্যান্য মাধ্যমে বাল্য বিয়ে বন্ধ করি এর পরিমাণ অর্ধশত হবে।