গাজী মমিন,ফরিদগঞ্জ:
সবজি বিক্রেতা মিছির আলী (৬৫) বাড়ি ফিরছিলেন। তার কথা অনুযায়ী ঘড়ির কাটায় রাত সাড়ে ৯টা। রাস্তায় সাদা লুঙ্গি পড়া একটি লোককে রাস্তার পাশে বিপরীত দিকে দাড়িয়ে থাকতে দেখলেন। মনে মনে ভাবলেন হয়তবা প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিচ্ছেন। কিন্তু কিছু সময়ই পরই হঠাৎ সেই যুবকই পিছন থেকে এসে তার মাথায় টর্চ লাইট দিয়ে আঘাত করলো। তিনি মাথায় হাত দিয়ে পিছনে ফিরে যুবকটিকে চিনতে পারলেন। এসময় চিৎকার দেয়ার সাথে সাথে দুর থেকে মোটর সাইকেল আসার শব্দ পেয়ে পালিয়ে গেল আঘাতকারী যুবক হৃদয় হোসেন । মিছির আলীর চিৎকার শুনে আশপাশের লোকজন এগিয়ে এসে তাকে পাশ^বর্তী বাজারে একজন গ্রাম্য চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যায়। চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত তার জ্ঞান ছিল। এরপর তিনি যখন চোখ মেলেন তখন তিনি হাসপাতালের বেডে। এভাবেই গত ১১ নভেম্বর ফরিদগঞ্জ উপজেলার চরদুঃখিয়া পুর্ব ইউনিয়নের একলাশপুর গ্রামে এই ঘটনা ঘটে। ঘটনার পরপরই রাতেই পুলিশ ঘটনার সাথে জড়িত সন্দেহে হৃদয়কে আটক করে নিয়ে আসে। যদিও হৃদয় একদিন পর জেল থেকে জামিনে বেরিয়ে আসেন। সর্বশেষ গত ৫ ডিসেম্বর হৃদয় হোসেনকে তার পরিবারের লোকজন অতিষ্ট হয়ে পুনরায় পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছে বলে জানা গেছে।
কিন্তু ঘটনা অন্যখানে। বৃদ্ধ মিছির আলীর উপর হামলার ঘটনায় বৃদ্ধের তথ্যমতে হৃদয় একা জড়িত থাকলেও স্থানীয় একটি প্রভাবশালী মহল রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে অন্যদের জড়িত করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। ইতিমধ্যেই থানায় তদবির চালানো হচ্ছে।
ঘটনার আদ্যোপান্ত জানতে সরেজমিন গেলে কথা হয়, বিভিন্ন মানুষের সাথে। চরদুঃখিয়া পুর্ব ইউনিয়নের পুর্ব একলাশপুর গ্রামের তুলাতুলি বাজারে গিয়ে দেখা মিলে ওই বৃদ্ধ মিছির আলীর। একলাশপুর গ্রামের মৃত আইয়ুব আলীর ছেলে মিছির আলী (৬৫) বিভিন্ন বাজারে সবজি বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন।
তিনি জানান সেদিনের কথা। রাত সাড়ে ৯টার দিকে তার উপর হামলা করা হয়। তিনি বলেন,‘আমাকে যখন মাথায় আঘাত করা হয়, তখন আমার পুরোপুরি জ্ঞান ছিলো। আমার মাথায় বাড়ী দিয়েছে হৃদয়। আমি আর কাউকে দেখেনি। তিনি জানান, তার ছেলে থানায় মামলা করেছে। তবে পুলিশ আমার সাথে কোন কথা বলেনি।
তুলাতুলি বাজারের গ্রাম্য চিকিৎসক শিপন জানান, ঘটনার দিন রাতে মিছির আলীকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেই। তবে সেই সময়ে মিছির আলীর জ্ঞান ছিল।
এদিকে ঘটনার স্বীকার মিছির আলী নিজে তার উপর হামলাকারীকে চিনতে পারলেও অভিযোগ রয়েছে এলাকার একটি চক্র একই গ্রামের মৃত লক্ষণ সরকারের ছেলে সেলুন ব্যবসায়ী স্বপন সরকারকে এই ঘটনার সাথে জড়িত করার চেষ্টা করছে। যদিও ঘটনার সময় স্বপন সরকার দুই কিলোমিটার দুরে হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি মন্দির পুর্ব আলোনিয়া রাধাগোবিন্দ মন্দির অবস্থান করছিল। সেই সময়ে ওই মন্দিরে থাকা সিসি টিভি ফুটেজে তা দেখা গেছে। কিন্তু তারপরও দরিদ্র ওই পরিবারের সদস্যরা মামলা আতংকে প্রতিটি মুর্হুত পার করছেন।
স্থানীয় সাবেক ইউপি সদস্য ও ওয়ার্ড আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক আমির হোসেন বেপারী জানান, মিছির আলীর উপর হামলার ঘটনা তিনি জেনেছেন। কিন্তু এই ঘটনার সাতে স্বপন কোন ভাবেই জড়িত নয়। কারণ রাত সাড়ে ৮টা থেকে ১২টা পর্যন্ত তিনি পুর্ব আলোনিয়া রাধাগোবিন্দ মন্দিরের পাশেই ছিলেন। মন্দির কমিটির অনুরোধ তিনি পুরো কার্ত্তিক মাস জুড়ে হওয়া অনুষ্ঠানের শান্তি শৃংখলা রক্ষায় অবস্থান করেন। গত ১১ নভেম্বর স্বপন মন্দিরের প্রবেশের পুর্বে পাশের চায়ের দোকানে ছিল। ঘটনা শুনে আমি নিজে সিসিটিভি ফুটেজ দেখেছি। স্বপন ৯টা ৩৭/৩৮ মিনিটে চায়ের দোকান থেকে মন্দির গেইট দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে। এর আগে সাড়ে ৮টার দিকে পর তিনি স্বপনকে তার ও স্ত্রীসহ রাস্তা দিয়ে মন্দিরের দিকে আসতে দেখেন।
কথা হয় ওইদিন মন্দিরে থাকা বেশ কয়েকজন যুবকের সাথে। এর মধ্যে অরুন. মিঠুন সহ বেশ কয়েকজন জানান, তারা নিজে সিসি টিভি ফুটেজ ছাড়াও ওই দিন রাতে মন্দিরে স্বপন সরকারকে দেখেছেন।
স্বপন সরকারের ভাই সুমন সরকার জানান, তার ভাই স্বপন সরকার তার ভাই ঢাকায় সেলুনের কাজ করে। কার্ত্তিক মাসে পুর্ব আলোনিয়া রাধাগোবিন্দ মন্দিরে অনুষ্ঠান উপলক্ষে কয়েকদিনের জন্য বাড়ি আসে। এসময় মাঝে মধ্যে তার ভাই তুলাতুলি বাজারের তাদের সেলুনে কাজ করতেন। ঘটনার একদিন আগে সেলুনে কাজ করার সময় দোকানে ধুমপান না করার জন্য হৃদয় হোসেনকে নিষেধ করাকে কেন্দ্র করে স্বপনের সাথে তার ঝগড়া হয়।
ঘটনার দিন রাতে তার ভাই স্বপন সরকার মা ও তার স্ত্রীকে নিয়ে পুর্ব আলোনিয়া রাধাগোবিন্দ মন্দিরে অনুষ্ঠানে যায়। এরপর রাতে বাড়ি ফিরে আসে। ঘটনার পর একটি চক্র তার ভাই স্বপনকে জড়ানোর অপচেষ্টা শুরু হয়। অথচ ঘটনার সময় আমার ভাই ওই মন্দিরে অবস্থান করছিল তার প্রমাণ রয়েছে। তাছাড় এর আগ পরে মন্দিরের আশপাশে ছিলেন লোকজন তা দেখেছেন। আমরা দরিদ্র মানুষ। কিন্তু মামলার ভয়ে আমাদের প্রতি মুহূর্ত কাটে। আমরা এই অবস্থা থেকে মুক্তি চাই। একই কথা বলেন, স্বপনের মা ও তার স্ত্রী।
ঘটনার বিষয়ে মুঠো ফোনে স্বপন সরকার জানান, তিনি ওই দিন রাত সাড়ে ৮টার দিকে মা ও স্ত্রী সন্তানকে নিয়ে পুর্ব আলোনিয়া রাধাগোবিন্দ মন্দিরে যাই। মা ও স্ত্রীকে মন্দিরে দিয়ে আমি মন্দিরের পাশে চায়ের দোকানে অবস্থান করি। পরে সেখানে নাস্তা খেয়ে এবং পরিচিত লোকজনের সাথে কথা বলে মন্দিরে প্রবেশ করি। অনুষ্ঠান শেষে সকলে মিলে বাড়ি চলে যাই।
বিষয়টি নিয়ে অভিযোগের মিছির আলীর ওপর হামলার ঘটনার মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ফরিদগঞ্জ থানার উপপুলিশ পরিদর্শক আনোয়ার হোসেন জানান, অভিযোগ পেয়ে মামলা রুজু করা হয়েছে। তবে নিরাপরাধ কোন ব্যক্তিকে হয়রানি করা হবে না।