গাজী সালাহউদ্দিন:
১৭২০ সালে ইউরোপে শেষবারের মতো এশিয়ায় মহামারী আকার ধারণ করেছিল প্লেগ রোগ। একে তখন বলা হতো’ ব্ল্যাক ডেথ’। এটি মূলত সংক্রমণ শুরু হয়েছিল তার অনেক পূর্ব থেকেই। এটি চীন-ভারত সিরিয়া ও মিশর সহ তখন আরো অনেক দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এই প্লেগ মহামারীতে প্রত্যেক জনবহুল এলাকায় ৪০% মানুষ মারা যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৭০% পর্যন্ত মারা গিয়েছিল। ইতিহাসবিদদের মতে এ রোগে আক্রান্ত হয়ে তখন বিভিন্ন সময়ে অন্তত ১০ কোটি লোক মারা গিয়েছিল। এটিও ছিলো করোনা ভাইরাসের মতো ছোঁয়াচে রোগ এবং কিছু উপসর্গও এর সাথে মিল রয়েছে। ১৯১৮ -১৯১৯ সালের সময়ের দিকে সারা বিশ্বকে ধরাশায়ী করেছিল ইনফ্লুয়েঞ্জা নামক মহামারী। প্রায় ৪থেকে ৫ কোটি মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েছিল এ প্রাণঘাতি রোগটি। এটিও ছিল এক ধরনের সংক্রমণ ব্যাধি। সে রোগটিও একসময় চিকিৎসার মাধ্যমে স্বাভাবিক পর্যায়ে নিয়ে আসা হয়। এ রোগে এখনো অল্পসংখ্যক মানুষ মাঝে মাঝে আক্রান্ত হয় এবং সাধারণ চিকিৎসায় আবার নিরাময় হয়। এক সময় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কলেরা নামক মহামারীতেও বহু লোকের প্রাণহানি ঘটেছিল। এটিও একটি সংক্রমণ ব ব্যাধি ছিল। এটি এক ধরনের ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণে সংক্রমণ হতো।২০১২ এর গোড়ার দিকে পশ্চিম আফ্রিকার গিনিতে প্রথমে মহামারী আকার ধারণ করেছিল। ক্রমান্বয়ে অন্যান্য দেশেও পরে তা ছড়িয়ে পড়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানের চেষ্টায় অবশেষে এর চিকিৎসায় অনেকের প্রাণ রক্ষা পায়। বসন্ত রোগের কথা অনেকের অজানা নয়। জলবসন্ত ও গুটি বসন্ত সারাবিশ্বের বিভিন্ন দেশে তখনকার সময় অনেক লোকের প্রাণহানি ঘটেছিল। এটিও ধরনের সংক্রামক রোগ ছিল। তখন উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা ছিল না বলে বিভিন্ন কুসংস্কারেও আচ্ছন্ন ছিল মানুষ। এই বসন্ত রোগে মানুষ নিজেদেরকে এতটাই অনিরাপদ মনে করতো, কারো বসন্ত হলে তাকে অনেক দূরে কি নিয়ে রেখে আসা হতো। এবং সেখানে তার মৃত্যু হতো। ১৯৭৪ সালের দিকেও বসন্ত রোগে ভারতে হাজার হাজার লোকের মৃত্যু হয়। আক্রান্তদের বিচ্ছিন্ন করে তখন সেই মহামারী সামাল দেওয়া হয়েছিল। এখনো বসন্ত রোগ সিজনালি আসে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের বদৌলতে এখন আর এটি তেমন ক্ষতির কারণ হতে পারে না। সামান্য চিকিৎসায় এখন এ বসন্ত রোগ ভালো হয়। কালক্রমে এভাবে আরো অনেক রোগ মহামারী হিসেবে এসেছিল বিভিন্ন নামে। কিন্তু চিকিৎসাবিজ্ঞানের চেষ্টায় এখন সে সকল রোগের পাদুর্ভাব দেখা গেলেও এগুলি এখন আর বড় ধরনের ক্ষতির কারণ হতে পারে না। বিভিন্ন সময় চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা এই সংক্রামক রোগের প্রতিষেধক আবিষ্কার করে মানুষকে রক্ষা করেছেন। পাশাপাশি এ সকল রোগের ওষুধ আবিষ্কার করেছেন, যা খেলে সহজে নিরাময় সম্ভব। সর্বশেষ ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের দিকে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হয় চীনের ওয়ান শহরে।যার নামকরণ করা হয় কোভিড-১৯। মাত্র অল্প কয়েক সপ্তাহের মাথায় চীনের প্রায় সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে এ ভাইরাসটি। মার্চের শুরুতে প্রাণঘাতী এ ভাইরাসটি ক্রমান্বয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। যে কারণে এটিকে বৈশ্বিক মহামারী বলা হয়ে থাকে। প্রথমত বলা হচ্ছে, বাদুড় অথবা অন্য কোন প্রাণী থেকে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু বিশ্বের অন্যান্য দেশ চীনের এই কথার সাথে একমত পোষণ করতে পারেনি। অন্যান্য দেশের অভিযোগ, উহান শহরে ল্যাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতে গিয়ে এর সংক্রমণ ঘটে। বিষয়টা যেটাই হোক, যেভাবেই হোক না কেন, চীন কিন্ত এর দায় এড়াতে পারে না। কারণ তারা যতো নিকৃষ্ট ধরনের খাবার খেয়ে যদি এর সংক্রমণ ঘটিয়ে থাকে তাহলেও তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোই যায়। কিন্তু বিধিবাম! চীনের কাছে বেশ কিছু দেশ বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক কারণে আওয়াজ করে কথা বলতে পারছে না।যদিও আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এই অভিযোগ এখনও অনড়। বৈশ্বিক মহামারী করোনা যেভাবেই সংক্রমিত হয়েছে, সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হচ্ছে এটা একটা প্রাণঘাতী ভাইরাস এবং এই ভাইরাস থেকে আমাদের প্রাণে বাঁচার চেষ্টা করতে হবে। ইতিমধ্যে প্রাণঘাতী এ ভাইরাসে ১৯ জুন ২০২০ পর্যন্ত সারাবিশ্বে ৮৬ লাখ মানুষ আক্রান্ত হয়েছে। মৃত্যু হয়েছে সাড়ে ৪ লাখের বেশী। আর সুস্থ হয়েছেন প্রায় ৪৫ লাখ মানুষ ।অন্য দিকে আমাদের দেশে আক্রান্ত হয়েছে ১,০২,২৯২ জন।মৃত্যু হয়েছে ১,৩৩৪ জন। সুস্থ হয়েছেন ৪০,১৬০জন। অনেক ধনী ও উন্নত দেশে করোনা ভাইরাস থেকে মানুষকে রক্ষা করার জন্য সরকারকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। কিছু কিছু দেশে প্রাণঘাতী ভাইরাসের কাছে অসহায় বনে গেছে সাধারণ মানুষ ও সরকার প্রধানরা। এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলে মানুষের শরীর কিভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং তা থেকে সাময়িক ভাবে নিস্তার পাওয়া যায় তা ইতিমধ্যেই বিভিন্ন প্রচার প্রচারণায় অনেকের জানা হয়ে গেছে। সুতরাং এ প্রাণঘাতী ভাইরাসের ভ্যাকসিন আবিষ্কার ও বাজারজাত না হওয়া পর্যন্ত পৃথিবীর সব দেশের মানুষকে কিছু সুনির্দিষ্ট স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। আর এর মাধ্যমে এই ভাইরাসকে প্রতিরোধ করা সম্ভব। যেমন -সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা, মাক্স পরা, হ্যান্ড স্যানিটাইজার ব্যবহার করা, হোম কোয়ারান্টিনে থাকা। যুগের পর যুগ ধরে আসা বিভিন্ন মহামারি এর মত এই করোনা ভাইরাসেরও ভ্যাকসিন আবিষ্কার হবে। মানুষ সুরক্ষিত হবে প্রত্যাশা এখন সকলের। ওই পর্যন্ত সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সুরক্ষিত থাকার চেষ্টা করতে হবে।
লেখকঃ সাংবাদিক,কলামিস্ট, শিক্ষক ও চারুশিল্পী