ফরিদগঞ্জ প্রতিনিধি:
চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ পৌরসভার অধীন ফরিদগঞ্জ বাজারের ড্রেন এর কাজে হযবরল অবস্থার অভিযোগ উঠেছে। কাজে অনিয়ম ও নিম্নমান থাকার পরও দেখার যেনো কেউ নেই। এ নিয়ে জনমনে নানা জল্পনা কল্পনা ভেসে বেড়াচ্ছে। কেউ বলেছেন, সরকারী কাজ ও জনগনের টাকার সঠিক ব্যবহার হওয়া বাঞ্ছনীয়। অন্যথায় এমন হযবরল কাজ করার কোনো মানে হয় না।
প্রত্যক্ষদর্শী ও অভিজ্ঞ কয়েকজন ব্যক্তি সোমবার দুপুরে সাংবাদিকদের কাছে অনুযোগ করে বলেন, মূল্যবান এ কাজ দেখার কেউ যখন নেই, তখন আপনারা খোঁজ নিয়ে জনস্বার্থে রিপোর্ট করুন। এতে সংশ্লিষ্ট মহলের চোখ কিছুটা হয়তো খুলবে। তৎক্ষনাত, কাজেরস্থলে উপস্থিত হন কয়েকজন সংবাদকর্মী। প্রথমেই খোঁজ নিয়ে জানা গেলো ওই কাজ দেখাশোনার দায়িত্বপ্রাপ্ত রয়েছেন ফরিদগঞ্জ উপজেলা জনস্বার্থ অধিদপ্তর। কিন্তু, সেখানে ওই অধিদপ্তরের কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। বিস্তারিত খোঁজ খবর নেয়ার প্রায় দু’ ঘন্টার মধ্যেও দায়িত্বশীল কেউ সেখানে যাননি। কর্মরত শ্রমিকদের কাছে জানতে চাইলে তারা বলেন, এখানে ঠিকাদার নেই। তবে, তার নিয়োগকৃত লোক আছে। কিছুক্ষণ পরে তাকে দেখিয়ে দেয়া হয়। তার নাম সালাম মিয়া (৩৫)। প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, আমার কাছে ওয়ার্কওর্ডার, সিডিউল কিছুই নেই। কাজ করেন কিভাবে। এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ইঞ্জিনিয়ার যেভাবে বলেন, সেভাবে কাজ করি। ইঞ্জিনিয়ার কোথায়। ইঞ্জিনিয়ার মাঝেমধ্যে আসেন- তিনি বলেন। আজ এসেছেন কি না- এর জবাবে তিনি বলেন, না এখনও (বেলা এক ঘটিকা) আসেননি। তখন শ্রমিকগণ রড বাইন্ডিংয়ের কাজ করছিলেন। অভিজ্ঞজনের তথ্য মোতাবেক সালাম মিয়ার কাছে জানতে চাওয়া হয় এ ড্রেনে আপনারা কোথাও কি নীচ থেকে ইউ ডিজাইনে বাঁকা করে ভার্টিকেল (খাড়া) রড বাইন্ডিং করেছেন। তিনি জানালেন, না, তা করা হয়নি। তবে, ইউ ডিজাইনের উপরে রড বাঁকা করা হয়েছে। পেছনের দিকে তো উপরে স্লাব বসিয়ে দিয়েছেন। ফলে, উপরে ইউ ডিজাইন দেবেন কোথায় বা কেনো। এর কোনো উত্তর তিনি দিতে পারেন নি। অভিজ্ঞজনের মতে নীচ থেকে ইউ ডিজাইন না দিলে ড্রেনের পাশ দিয়ে ভারি মালবাহী যানবাহন চলাচল করলে ড্রেন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।
দেখা গেছে, খাড়া রডের ওপর টানা রডের বাইন্ডি এর ঘনত্ব (ফাঁক বা দূরত্ব) ৩০০ এম.এম. দেয়া হয়েছে। জানতে চাইলে সালাম মিয়া বলেন, এটা ২০০ এম.এম. হওয়ার কথা। বাড়িয়ে দেয়ার ফলে ভার্টিক্যাল ওয়ালের শক্তি কমে যাবে কি না অথবা এটা সিডিউল মোতাবেক হলো কি না। এমন প্রশ্নে তিনি বলেছেন “হ্যাঁ, শক্তি কমে যাবে ও সিডিউল মোতাবেক হয়নি”।
এদিকে, প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, ঢালাইতে কাজের শুরু থেকে লোকাল সেন্ট (বালি) দেয়া হয়েছে। অত্যন্ত নিম্নমানের খোয়া (কংক্রিট) ব্যবহার হয়েছে। কাজেরস্থলে লোকাল সেন্ট ও নিম্নমানের খোয়া দেখা গেছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সালাম মিয়া বলেন, কিছু দুই নম্বর খোয়া আছে। এটা কি সিডিউল সম্মত। এ প্রশ্নে তিনি বলেছেন, না, সিডিউলে এক নম্বর খোয়া দেয়ার নির্দেশনা রয়েছে। লোকাল সেন্ট এর বিষয়ে তিনি কোনো তথ্য জনাননি।
এদিকে, খোয়া, সিলেট সেন্ট, সিমেন্ট এর অনুপাত কতো হবে এটা জানা যায়নি। তবে, প্রত্যক্ষদর্শী ইকবাল হোসেন জানিয়েছেন, আমি দেখেছি ছয়টা খোয়া, একটা সিলেট সেন্ট, দুইটা লোকাল সেন্ট ও একটা সিমেন্ট দেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে জানার জন্য সালাম মিয়াকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।
প্রত্যক্ষদর্শী ব্যবসায়ী নুরু মিয়া (৫২) জানান, ঢালাইতে ব্যবহৃত খোয়া সবই দুই নম্বর। তিনি বলেন, শুধু তা নয়, খোয়ার সাথে প্রায় তিনভাগের দুইভাগ রাবিশ ছিলো ও আছে। ওই রাবিশসহ ঢালাই দেয়া হয়েছে। গতকাল (সোমবার) কয়েক ঘন্টা পর সে রাবিশসহ ঢালাই দিতে দেখা গেছে।
এদিকে, জহির (৩০) নামের বাজারের ব্যবসায়ীসহ কয়েকজন ব্যক্তি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ড্রেন এর বক্স কাটিং করে পাশেই রাস্তার ওপর মাটি রেখেছে। এতে, কোনো গাড়ি তো চলছেই না। হাঁটার জায়গাও নেই। রাস্তা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এ সড়কে প্রতিদিন কয়েক শহস্র যানবাহন ও পথচারী চলাচল করেন। রাস্তার পাশে চলার জায়গা থাকবে না- এমনটা হতে পারে না। কাজেও ধীর গতি।
বাজারের মোড়ের একজন ব্যবসায়ী বলেন, ব্রীজ এর দিকে থেকে আসা পথ সম্পূর্ণ বন্ধ করা হয়েছে। তদুপরি, বাজারের মেইন সড়কের ওপর মাটি, খোয়া, লোকাল সেন্ট, ঢালাই মেশিন ও রড ফেলে এ সড়কটিতেও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হয়েছে। এ বিষয়ে সালাম মিয়া বলেছেন, আমাদের এ ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই।
এদিকে, ড্রেন এর নির্মান কাজ আরম্ভ ও শেষ এর তারিখ, প্রাক্কলিত মূল্য, ইউ ডিজাইনে রড বাইন্ডিং, রড থেকে রডের দূরত্ব, লোকাল সেন্ট, নিম্নমানের খোয়া- এসব বিষয়ে কথা বলার জন্য বেলা একটা পঁয়ত্রিশ মিনিটে সংশ্লিষ্ট জনস্বাস্থ্য অফিসে উপস্থিত হয়ে ও দীর্ঘ সময়ে অপেক্ষা করেও কাউকে পাওয়া যায়নি। একই অফিসে বিকাল সাড়ে চার ঘটিকায় গিয়ে উপজেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী সোহরাব হোসেনকে পাওয়া যায়। গণমাধ্যম কর্মী পরিচয় পাওয়ার সাথেই ক্ষণবিলম্ব না করে তিনি বলেন, “আমি আপনাকে কোনো তথ্য দেবো না। আমার সাথে কথা বলতে হলে হেড অফিসের অনুমতি নিয়া আসেন। তথ্য অধিকার আইনে আমার মুখটা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে”। তাকে বিনয়ের সঙ্গে বলা হয়, আপনি সম্ভবত ভুল করছেন। বরং সরকার তথ্য অধিকার আইন করেছেন। সে মোতাবেক আপনি যে কোনো নাগরিককে তথ্য দেবেন। তিনি একই কথা বললে, জানতে চাওয়া হয় হেড অফিসের অনুমতি লাগবে- এমন চিঠি দেখাতে পারবেন কি না। এ সময়ে তিনি ক্ষেপে যান।
সে অফিস থেকে বেরহয়ে উপজেলা নির্বাহী অফিসার শিউলি হরিকে মুঠোফোনে বিষয়টি জানানো হয়। তিনি বলেন, তথ্য অধিকার আইন মোতাবেক তিনি এমন ব্যবহার করতে পারেন না। আমি মিটিংয়ে এ বিষয়ে কৈফিয়ত চাইবো ও বিস্তারিত খোঁজ খবর নেবো।
উপজেলা পরিষদ থেকে বের হয়ে ড্রেন নির্মানস্থলের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়ে অভিযোগকৃত নিম্নমানের মালামাল দিয়ে ঢালাই দিতে দেখা গেছে বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন। তারা আরও জানান, বিকাল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ জনস্বাস্থ্য প্রকৌশলী সোহরাব হোসেন একজন রিপোর্টারকে দিয়ে ড্রেনের পাশে দাঁড়িয়ে ফটোসেশন করেছেন। তারা, সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল উর্ধতন কর্তৃপক্ষের প্রতি দাবী জানিয়ে বলেছেন, গুরুত্বপূর্ণ এ কাজের পুংখানুপুংয়খ তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। সরকারী কাজ ও জনগনের টাকার সঠিক ব্যবহার হওয়া বাঞ্ছনীয়। অন্যথায় এমন হযবরল কাজ করার কোনো মানে হয় না।