• শনিবার, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:২৬ পূর্বাহ্ন

ফরিদগঞ্জে ডাকাতিয়া সংস্কারের অভাবে বিলীন হওয়ায় পথে, স্বপ্ন ভেঙ্গেছে মৎসজীবিদের

আপডেটঃ : সোমবার, ২৮ জুন, ২০২১

গাজী মমিন, ফরিদগঞ্জ (চাঁদপুর) প্রতিনিধি:
চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জে কচুরিপানার জট ডাকাতিয়া নদীটি ঘিরে ফেলায় নষ্ট হয়ে গেছে পানি। কোথাও কোথাও কচুরিপানার জট এতটাই চাপা যে, অনায়াসে এর উপর দিয়ে হেঁটে নদীর এপার থেকে ওপারে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। তার উপর জন্মেছে পরগাছা। পানি নষ্ট ও দূষিত হওয়ায় দেশিয় প্রজাতির মাছ মরে যাচ্ছে। অথচ সরকার প্রতি বছর দেশিয় মাছের উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে নদীসহ উন্মুক্ত জলাশয়ে লাখ লাখ টাকার মাছের পোনা অবমুক্ত করে আসছে।
ডাকাতিয়া নদীর উপর ভর করে এ উপজেলার কয়েক হাজার জেলে পরিবার বেঁচে আছে। কচুরিপানার ভয়াবহ জটে দূষিত পানিতে দেশিয় প্রজাতির মাছ ক্রমাম্বয়ে বিলুপ্ত হওয়ায় জেলেদের বেঁচে থাকার স্বপ্ন ভেস্তে যেতে বসেছে। এ ডাকাতিয়া নদীর সুস্বাদু মাছের চাহিদা ছিল দেশের সর্বত্র। ডাকাতিয়ায় এক সময় দেশিয় প্রজাতির বিশেষ করে পাবদা, সরপুটি, বোয়াল, শিং, মাগুর,কই, শইল, ফইলা, চিতল মাছসহ বিভিন্ন প্রজাতের প্রচুর পরিমানে আহরন করতেন জেলে পরিবার ও এ উপজেলার মানুষেরা। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে বাজারজাত হতো ডাকাতিয়া নদীটির সুস্বাদু মাছ।
এক সময়ের নামকরা ডাকাতিয়া আজ মরা ডাকাতিয়া নদীতে পরিণত হয়েছে। ১৯৬৩ সালে চাঁদপুর জেলার চাঁদপুর সদর, ফরিদগঞ্জ, হাইমচর, লক্ষ্মীপুর জেলার লক্ষ্মীপুর সদর, রামগঞ্জ এবং রায়পুরের কিয়দংশ নিয়ে প্রায় ১শ’ কিলোমিটার এলাকা নিয়ে শুরু হওয়া ৫৭ হাজার হেক্টর জমিকে বন্যামুক্ত রেখে বছরে একাধিক ফসল ও মাছ উৎপাদনের জন্য চাঁদপুর সেচ প্রকল্প নামে ওই সময়ে ৫৪.৩০ কোটি ব্যয়ে প্রকল্পটি ১৯৭৮ সালে সম্পন্ন হয়। এরপর বস্তুত প্রমত্তা ডাকাতিয়া তার গতি ও স্রোত হারিয়ে ফেলে। কালের বিবর্তনে ফরিদগঞ্জ উপজেলার উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া ৬০ কিলোমিটার দীর্ঘ ডাকাতিয়া দখল, নব্যতা সঙ্কট এবং কচুরিপানা জটের কারণে নদীটি মৃতপ্রায় অবস্থায় পৌঁছেছে। এর সাথে গত এক দশক ধরে নদী থেকে ইচ্ছে মতো অবৈধ ড্রেজিং ও বাঁধ দিয়ে মাছ চাষের মাধ্যমে কিছু কিছু লোক লখোপতি হয়ে গেলেও ডাকাতিয়া নদী ক্রমশঃ খালে পরিণত হয়েছে। শুস্ক মৌসুমে এটি প্রায় পানি শূন্য ও কচুরিপানার কারণে দুর্গন্ধ ও ব্যবহার উপযোগী হয়ে পড়ায় এই নদীর ওপর নির্ভরশীল প্রায় ১০ হাজার জেলে পরিবারকে অনেকটা বেকার জীবন কাটাতে হয়। এসব দুরাবস্থার কারণে ইতিমধ্যেই জেলে পরিবারের সদস্যরা তাদের পেশা পরিবর্তন করতে বাধ্য হচ্ছে। নদীর নাব্যতা কমে যাওয়ার কারণে এবং এর সাথে সংযুক্ত খাল সমূহে সেচ প্রকল্পের জন্য পর্যাপ্ত পানি যেতে না পারায় প্রতি বছরই উপজেলার বিভিন্ন অঞ্চলে সেচের পানির জন্য কৃষকরা ফসল ফলাতে নিদারুণ কষ্ট ভোগ করতে হচ্ছে। চাঁদপুর সেচ প্রকল্প বাঁধ তৈরির পর বছরে স্থান ভেদে তিনটি ফসল কৃষকরা ঘরে তোলার পাশাপাশি উপজেলার বিভিন্ন স্থানে গড়ে তুলেছে মৎস্য খামার। গত ৪ দশকে ফরিদগঞ্জ উপজেলা খাদ্যে স্বয়ং সম্পন্ন হওয়ার সাথে মাছে উৎপাদন করে আমিষের চাহিদা পূরণের পাশাপাশি নিঃস্ব থেকে স্বাবলম্বী হয়েছে অনেক মৎস্যজীবী। বর্তমানে ফরিদগঞ্জে কোটি কোটি টাকার মাছের চাষ হচ্ছে। এসব কিছুই মাঝে মাঝে থমকে দাঁড়ায় ডাকাতিয়া নদীর কারণে। নাব্যতা সঙ্কটের কারণে বর্ষা মৌসুমে নদীতে পানির পরিমাণ বাড়লেও দু’কুল উপচিয়ে তা পার্শ্ববর্তী ধান ক্ষেত ও মাছের প্রজেক্টগুলোতে প্রবেশ করায় প্রায় প্রতি বছরই মাছ চাষীদের লোকসানের ঘানি টানতে হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের চোখে বিষয়টি নজরে এলেও অর্থবরাদ্দের অভাবে ডাকাতিয়া নদীতে বেড়ে উঠা কচুরিপানা,পরগাছার জট গুলো অপসারনের কোন প্রদক্ষেপ নেয়নি কর্তৃপক্ষ। পানি উন্নয়ন বোর্ড কচুরিপানা দূরীকরণে নামমাত্র বরাদ্দ দিয়ে থাকে। যা দিয়ে ৬০ কিলোমিটার দীর্ঘ ডাকাতিয়া নদীর একাংশও পরিষ্কার করা সম্ভব হয় না। এছাড়া কর্মসৃজন প্রকল্পের মাধ্যমে কয়েক বছর আগে ডাকাতিয়া নদী সংরক্ষণে চাঁদপুর জেলা প্রশাসন উদ্যোগ নিলেও তা অজানা কারনে থমকে গেছে। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে ফরিদগঞ্জ উপজেলা পরিষদ ডাকাতিয়া নদী রক্ষা ও পর্যটনের স্থান হিসেবে চিহিৃত করতে ওই সময়ের সংসদ সদস্য ডিও লেটারসহ একটি প্রকল্প জমা দেন। পরিকল্পনা কমিশনে তা পড়ে থাকায় এখনো আলোর মুখ দেখেনি। তাই প্রকল্প নিয়ে উপজেলাবাসীর স্বপ্ন স্তিমিত হয়ে গেছে।

স্থানীয়রা বলেন, এক সময়ের প্রমত্তা ডাকাতিয়া পণ্য পরিবহনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতো। এটিকে বাঁধ দিয়ে শুধু মৃতপ্রায় করা হয়নি, নদীর তীরভূমি অবৈধভাবে ভরাট করে স্কুল,কলেজসহ বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, নোংরা আবর্জনা ফেলা, সুয়ারেজসহ হাট-বাজারের ড্রেনের পানির শেষ ঠিকানা হওয়ায় নদীটি এখন মরা খালে পরিণত। ফলে সবুজ কচুরিপানায় বিবর্ণ ডাকাতিয়া নদী এখন আবদ্ধ জলাশয়ে রূপ নিয়েছে।

মৎসজীবি আবু পাটওয়ারীসহ বেশ কয়েক জনের সাথে ডাকাতিয়া নদীটির বিষয়ে কথা বলে জানা যায়, ডাকাতিয়া একটি প্রাচীন ও ঐতিহ্যবাহী নদী। এ নদী ঘিরে রয়েছে অনেক জনশ্রুতি। একসময় ডাকাতিয়া নদী তীব্র খরস্রোতা ছিল। মেঘনার এই শাখা নদী ডাকাতিয়ায় মেঘনার উত্তাল রূপ ফুটে উঠত। ফলে ডাকাতিয়ার করালগ্রাসে নদীর দুই পাড়ের মানুষ সর্বস্ব হারাত। ডাকাতিয়া পাড়ি দিতে গিয়ে বহু মানুষের সলিল সমাধিও ঘটেছে। ডাকাতের মতো সর্বগ্রাসী বলেই এর নাম হয়েছে ডাকাতিয়া।
অন্যদিকে নামকরণের অপর ইতিহাস থেকে জানা যায়, এই নদী দিয়ে মগ-ফিরিঙ্গি নৌ-দস্যুরা নোয়াখালী ও কুমিল্লা জেলায় প্রবেশ করতো। তাদের মাধ্যমেই ডাকাতি হতো। ডাকাতির উপদ্রবের কারণে নদীটির নাম ডাকাতিয়া হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
তৎকালীন কলকাতাস্থ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাউন্সিলের পক্ষে কোর্ট অব ডিরেক্টর সভার কাছে ১৭৫৮ খ্রিস্টাব্দের ১০ জানুয়ারি পেশকৃত একটি চিঠির মাধ্যমে নৌদস্যুদের উপদ্রবের চিত্র পাওয়া যায়। ডাকাতিয়া নদী বাংলাদেশ-ভারতের একটি আন্তঃসীমান্ত নদী। দৈর্ঘ্য ১৪১ কিলোমিটার (৮৮ মাইল), গড় প্রস্থ ৬৭ মিটার। ডাকাতিয়া নদী মেঘনার একটি উপনদী। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পাহাড় থেকে উৎপন্ন হয়ে কুমিল্লা জেলার বাগসারা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে এবং পরবর্তীতে চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জ হয়ে লক্ষ্মীপুর জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। একই সাথে নদীটি কুমিল্লা-লাকসাম চাঁদপুরের শাহরাস্তি ও হাজীগঞ্জ উপজেলা অতিক্রম করে চাঁদপুর মেঘনা নদীতে মিশেছে। বর্ষাকালে ভারতের দিক থেকে যে পাহাড়ি প্রবাহ গ্রহণ করে তার পরিমাণ খুবই সীমিত।
বিষয়টি নিয়ে ফরিদগঞ্জ উপজেলা ডাকাতিয়া নদীরক্ষা কমিটির সাধারণ সম্পাদক মোশারফ হোসেন নান্নুর সাথে কথা হলে তিনি জানান, কচুরিপানা গো-খাদ্য ও ভালো সার হিসেবে পরিচিত। কিন্তু ডাকাতিয়া নদী দূষণমুক্ত রাখা, দেশিয় প্রজাতির মাছ রক্ষা এবং জেলেদের জীবিকা নির্বাহ অব্যাহত রাখতে কচুরিপানা পরিষ্কার করা ছাড়া বিকল্প কোন পথ নেই।
তিনি আরো বলেন. উপজেলা মৎস কর্মকর্তা সহ উপজেলা প্রশাসন বরাবরে অনেকবার স্বারক লিপি পেশ করেছেন ডাকাতিয়া নদীটির কচুরিপানা অপসারন করে নদীটির পূর্বের রূপ পিরিয়ে আনার জন্য। এতে করে পানি যেমন দূষন থেকে রক্ষা পাবে জেলে পরিবার গুলোর আর্থিক অভাব দূর হবে। বর্তমানে নদীটির বিভিন্ন স্থানে বাঁধ দিয়ে দখল করে নিয়ে একটি চক্র,সংশ্লিষ্ট প্রশাসন যদি ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে হয়তো ডাকাতিয়া নদী বিলীন হয়ে যাবে।
বিষয়টি নিয়ে উপজেলা মৎস কর্মকর্তা মোসা. ফারহানা আকতার রুমা জানান, ডাকাতিয়া নদীটির এমন চিত্র বহুদিন ধরে, কচুরিপানা সহ বিভিন্ন আবর্জনায় নদীটি যে সমস্যার সম্মুখিন হয়েছে। তার সমাধান করতে হলে বিশাল অর্থ বাজেটের প্রয়োজন। এছাড়া ডাকাতিয়া নদী রক্ষা কোন সমাধান আমার জানা নেই।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শিউলী হরি জানান, ডাকাতিয়া নদীর বিষয়টি পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীনস্থ, ফরিদগঞ্জে পানি উন্নয়ন বোর্ডের অফিস নেই, জেলাতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের অফিস রয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড ব্যবস্থা নিতে চাইলে জেলা প্রশাসক মহোদয়ের নির্দেশনা মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।


এই ক্যাটাগরির আরো নিউজ

ফেসবুকে মানব খবর…