বিশেষ প্রতিনিধি :
ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত সারাদেশে রোগীর সংখ্যা বেড়েছে, বেড়েছে রক্তের চাহিদাও। অনেকে আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে রক্তের চাহিদা মিটিয়ে দ্বারস্থ হচ্ছেন ব্লাড ব্যাংকগুলোতে। ব্লাড ব্যাংকগুলো বলছে, ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ায় আগের চেয়ে রক্তের চাহিদা বেড়েছে প্রায় পাঁচগুণ। চাহিদা মেটাতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন তারা।
চিকিৎসকরা বলছেন, একজন স্বাভাবিক মানুষের রক্তে প্লাটিলেটের হার প্রতি ১০০ মিলিলিটারে দেড় লাখ থেকে চার লাখ। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে রোগীর রক্তের প্লাটিলেট কাউন্ট এক লাখের নিচে চলে আসে। প্লাটিলেট ২০ হাজারের নিচে নেমে এলে কোনো আঘাত ছাড়াই রক্তক্ষরণ হতে পারে, যেমন- নাক বা দাঁতের মাড়ি দিয়ে রক্তপাত, মলের সঙ্গে রক্ত আসা ইত্যাদি।
ডেঙ্গু হলে অতিরিক্ত রক্ত ও প্লাটিলেটের প্রয়োজন হয়। এক ব্যাগ প্লাটিলেটের জন্য চার ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন। তাই ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় বেড়েছে রক্তের চাহিদা।
ব্লাড ব্যাংকগুলো বলছে, ডেঙ্গুর কারণে গত ৩০ দিনে রক্তের চাহিদা বেড়েছে প্রায় পাঁচগুণ। বেশির ভাগ রোগীর স্বজন পজিটিভ গ্রুপের রক্তের জন্য ভিড় করছেন। তবে নেগেটিভের চাহিদাও কম নয়।
সরেজমিন শান্তিনগরের কোয়ান্টাম ব্লাড ব্যাংকে গিয়ে দেখা গেছে, ব্লাড ব্যাংকের রিসিপশনে রোগীর স্বজনরা হাসপাতাল থেকে আনা রক্তের চাহিদাপত্র জমা দিচ্ছেন। এরপর ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা। কিছুক্ষণ পরপর রোগীর নাম ধরে ডাকা হচ্ছে এবং চাহিদা অনুযায়ী রক্ত কোন দিন এবং কোন সময়ে দেয়া হবে তা জানানো হচ্ছে।
নিজের মেয়ের ‘এ-নেগেটিভ’ রক্তের জন্য সেখানে উপস্থিত হয়েছেন বাবা রফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘গতকাল একটি ব্লাড ব্যাংকে গিয়েছিলাম। সেখানে না পাওয়ায় আজ কোয়ান্টামে আসলাম। তারা চার ঘণ্টা সময় চাইলেন। এরপর জানাবেন।’
ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের রক্তের চাহিদা জানতে চাইলে স্বেচ্ছায় রক্তদান প্রতিষ্ঠান কোয়ান্টামের দায়িত্বরত কর্মকর্তা তারেকুল ইসলাম জানান, ডেঙ্গু আক্রান্তদের রক্তের অনেক চাহিদা। গত কয়েকদিন ধরে এ চাহিদা আরও বেড়ে গেছে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্তদের স্বজনরা রক্তের জন্য ভিড় করছেন। খবু ভয়াবহ অবস্থা, চাহিদা এত বাড়ছে যে, সময় মতো আমরা রক্ত দিতে হিমশিম খাচ্ছি।
কোয়ান্টাম ব্লাড ব্যাংকের দায়িত্বপ্রাপ্ত অপর কর্মকর্তা হাসান খান বলেন, চলতি বছরের জুনে আমরা ৫০০ থেকে ৭০০ ব্যাগ রক্ত সরবরাহ করেছি। কিন্তু জুলাইয়ের ২৬ তারিখ পর্যন্ত এ সংখ্যা ৩৫০০-তে গিয়ে ঠেকেছে। ২০১৮ সালের জুলাইতেও হঠাৎ রক্তের চাহিদা বেড়েছিল। ওই বছর এখান থেকে মোট ২৫০০ ব্যাগ রক্ত সরবরাহ করা হয়।
বাঁধন কেন্দ্রীয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক জোনাহি সরদার বলেন, গত কয়েক মাসের গড় চাহিদার তুলনায় জুলাই মাসে রক্তের চাহিদা প্রায় ৪-৫ গুণ বেড়েছে। আগে প্রতিদিন ৫০-৬০ ব্যাগের চাহিদা থাকলেও বর্তমানে প্রতিদিন ১০০ থেকে ১২০ ব্যাগ রক্তের চাহিদাপত্র পাচ্ছি। অতিরিক্ত রক্তের অন্যতম কারণ ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। ডেঙ্গুতে একজনের এক ব্যাগ প্লাটিলেটের জন্য চার ব্যাগ রক্ত লাগে৷ এ কারণেই চাহিদা বেড়েছে। পজিটিভ গ্রুপের চাহিদা বেশি।
বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট ব্লাড ব্যাংকের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ডা. জাহিদুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, প্রতি মাসে আমাদের ২০০ থেকে ৩০০ ব্যাগের চাহিদা থাকলেও গত ৩০ দিনে মোট ১২৫০ ব্যাগ রক্তের চাহিদা পেয়েছি৷ এর মধ্যে ‘ও-পজিটিভ’ এর চাহিদা বেশি।
তিনি বলেন, রোগীর স্বজনরা চিকিৎসকের পরামর্শপত্র নিয়ে আমাদের কাছে আসলে আমরা সেই চাহিদা অনুযায়ী রক্ত অথবা প্লাটিলেট সরবরাহ করি। পরামর্শপত্র নিয়ে আগতদের মধ্যে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যাই বেশি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১৮ সালে ১০ হাজার নারী-পুরুষ ও শিশু ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে নতুন রেকর্ড গড়েছিল। চলতি বছরের ২৫ জুলাই (বৃহস্পতিবার) পর্যন্ত ডেঙ্গুতে আক্রান্তের সংখ্যা নয় হাজার ২৫৬ জন। তাদের মধ্যে চলতি মাসেই সর্বোচ্চ সংখ্যক সাত হাজার ১১২ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের হেলথ ইমারজেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম ঢাকার ১২টি সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত হাসপাতাল এবং ১৭টি বেসরকারি হাসপাতালের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বিভিন্ন হাসপাতালে দুই হাজার ৩২২ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি ছিল। এর মধ্যে শুধু ২৫ জুলাই ভর্তি ছিল ৫৪৭ জন, আগের দিন যা ছিল ৫৬০ জন।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, এ বছর ডেঙ্গুতে আটজন মারা গেছে। তবে বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থার মতে এ সংখ্যা প্রায় ৩৩ জন।