গাজী মমিন,(চাঁদপুর) ফরিদগঞ্জ প্রতিনিধি:
চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জে গত ৩৬দিনেও অটোরিক্সা চালক ফয়েজ খান হত্যা ঘটনার রহস্য উন্মোচন হয়নি। ঘটনার সপ্তাহ খানেক পর জড়িত সন্দেহে পাশ^বর্তী হাইমচর উপজেলা থেকে বোরহান নামে এক যুবককে আটকের পর তার কাছ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেয়েছে বলে দাবী সিআইডি পুলিশের। এছাড়া বোরহানের কাছ থেকে ফয়েজের ব্যবহৃত মোবাইলটি উদ্ধার করেছে সিআইডি পুলিশ। তবে ঘটনার সাথে জড়িত সন্দিগ্ধরা পলাতক রয়েছে বলে সিআইডি জানায়। এদিকে, একমাত্র ছেলেকে হারানোর সাথে সাথে ও পরিবারের আয়ের প্রধান উৎস অটোরিক্সাটি এখনো উদ্ধার না হওয়ায় চোখে সরষে ফুল দেখছে ফয়েজের পরিবার। সপ্তাহান্তে এই করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও তিনটি ঋণের কিস্তি দিতে রীতিমত হিমশিম খেতে হচ্ছে পরিবারটিকে। অপরদিকে, ফ্ল্যাক্সিলোড ও মোবাইলের সিম কার্ড বিক্রয়ের ব্যবসা করার সময় মামুন হোসেন নামে এক যুবক নিজের নামে রেজিস্ট্রেশন করা সিম অপর এক যুবককে ব্যবহার করতে দিয়ে বিপাকে পড়েছে সে ও তার পরিবার।
সরেজমিন ঘটনাস্থল ঘুরে দেখা গেছে, লামচর গ্রামের যেই স্থানে পরিত্যক্ত ঘরটি অবস্থিত, সেটি অনেকটা নির্জন। চরের মাঝখানে ও কালিগাছতলা নামে (সনাতন ধর্মালম্বীরা এখানে পূজা অর্চনা করে) একটি বট বৃক্ষের সন্নিকটে। চারপাশে বেড়া ও গাছপালা বেষ্টিত ঘরটি ভাঙ্গাচোরা। দিনের বেলা চরে আসা লোকজন ছাড়া সাধারণত কেউই এখানে আসে না। সন্ধার পর এলাকাটি ভুতুড়ে এলাকায় পরিনত হয়। এলাকাবাসীর সাথে কথা বলে জানা গেছে, সে ঘরটি পরিত্যক্ত ও নির্জন হওয়ায় স্থানীয় কিছু বখাটে যুবক সেখানে সন্ধ্যার পর মাদক সেবন ও জুয়াড় আসর বসাতো।
তাছাড়া ঘরে যাওয়ার জন্য সড়কটি দিয়ে হেটে যাওয়া ছাড়া কোন গতান্তর নেই। ফলে ফয়েজ খানকে এই নির্জন স্থানে হত্যা করা সুপরিকল্পিত চক্রান্ত বলে সুপষ্ট অনুধাবন করা যায়।
স্থানীয় লোকজন জানান, হাইমচর থেকে সিআইডি কতৃক আটককৃত বোরহান স্থানীয় আ: আজিজের ছেলে মালেক এর খালাতো ভাই। বোরহান আটক হওয়ার পর তার মা এই সংবাদ মালেকের মাকে মুঠোফোনে জানায়। এরপর মালেককে তার মা জিজ্ঞেস করেন ‘কিরে মালেক তুই বোরহানের কাছে কি মোবাইল বিক্রি করেছিস, তাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে’, এই কথা শোনার পর থেকেই মালেক বাড়ি থেকে বের হয়ে গা ঢাকা দেয়। মালেক পেশায় ট্রাকের হেলপার। তবে তার পিতা আ: আজিজসহ পরিবারের লোকজন জানায় সে কিছুদিন পরপরই সে নিরুদ্দেশ হয়, আবার ফিরে আসে। তবে স্থানীয় লোকজন জানায় তার চলাফেরা সন্দেহজনক।
অপরদিকে, বোরহান আটক হওয়ার সংবাদ পেয়েই চররাঘবরায় গ্রামের প্রবাসী মো: খোকন মিজির ছেলে হাবিবুর রহমান হাসানও (স্থানীয় ধানুয়া বাজারের অটোরিক্সা গ্যারেজের মেকানিক) পলাতক রয়েছে। তবে তার মা হাছিনা বেগম জানায়, গত ১০ এপিল সকালে জন্ডিসে আক্রান্ত হয়েছে বলে তার ছেলে হাসানকে ধানুয়া থেকে ফরিদগঞ্জ উপজেলা সদরের কেরোয়া গ্রামে কবিরাজের কাছে পাঠায়। হাসান কবিরাজের বাড়ি গেলেও তারপর থেকে সে নিখোঁজ হয়। পরে ১০ এপ্রিল রাতে ফরিদগঞ্জ থানায় একটি নিখোঁজ ডায়েরি করেন। এর পরদিন তার পরিবারের লোকজন হাসানের অটোরিক্সার গ্যারেজটির মালামাল নিয়ে আসে। এনিয়ে ঐ এলাকায় নানা গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে।
এছাড়া চররাঘবরায় গ্রামের জয়গঞ্জ গুদারার পাশে একসময় ফ্ল্যাক্সিলোড ও মোবাইলের সিম কার্ড বিক্রয়ের ব্যবসা করতো জনৈক মামুন নামে এক যুবক। সে সময় সিম কার্ডের বিভিন্ন অফার থাকায় অধিক মুনাফায় আশায় নিজের এনআইডি দিয়ে কয়েকটি সিম রেজিস্ট্রি করে রাখে সে। পরবর্তীতে দুই/তিনটি সিম সে ঐ এলাকার কয়েক যুবকের কাছে বিক্রি করে। এরমধ্যে অটো-রিক্সা গ্যারেজের মেকানিক হাবিবুর রহমান হাসানের কাছেও একটি সিম বিক্রি করেছিল। ইদানিং হাবিবুর রহমান হাসান নিখোঁজ হওয়ায় ও ফয়েজ হত্যার সাথে জড়িত সন্দেহে হাসানকে সিআইডি পুলিশ ঐ সিমের নাম্বারে সূত্র ধরে তাকে আটকের ব্যাপারে অভিযান চালাচ্ছে বলে এলাকাবাসী জানায়। তবে হাসানের ব্যবহৃত সিমটি মামুনের নামে রেজিস্ট্রি থাকায় মামুনও বিপাকে পড়তে পারে বলে এলাকাবাসী জানায়। মামুনের ভাই মাহবুব জানায়, তার ভাই মামুন দোকানে মুঠোফোনের ফ্লেক্সিলোড, সিম কার্ড বিক্রি করতো। অফারের সীমগুলো কোম্পানীর লোকজনের সহায়তায় তার নিজ নামে রেজিস্টেশন করে রাখতো। এগুলো আবার বিক্রি করতো। যাদের আইডি কার্ড নেই, তারা সেই সীমকার্ড ক্রয় করে ব্যবহার করতো। অভিযুক্ত হাসানেরও আইড কার্ড না থাকায় সে তার ভাইয়ের নামে রেজিষ্টেশন করা সীম কার্ড ব্যবহার করেছে। তাই মামুন ও তার পরিবার বিপাকে পড়েছে।
সরেজমিন অভিযুক্তদের বাড়ি ও আশপাশের এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, লাশ প্রাপ্তি স্থান ও সন্দেহভাজনদের বাড়ি খুব একটা বেশি দুরে নয়। ফলে অপরাধী ও তার সহযোগিরা সহজেই তাদের কাজ সম্পন্ন করতে পেরেছে। খুনের ঘটনার সাথে সন্দেহভাজনদের নিকটাত্মীয়দের সাথে কথা বললেও তারা সন্দেহভাজনরা কেন নিরুদ্দেশ হয়েছেন তা কারণ বলতে পারেন নি।
অপরদিকে, ফয়েজদের বাড়িতে গিয়ে তার পিতা আ: লতিফ খান ও মা আমেনা বেগমের সাথে কথা হলে তারা জানান, একমাত্র ছেলেকে ও পরিবারের আয়ের প্রধান উৎস অটোরিক্সাটি হারিয়ে চোখে সরষে ফুল দেখছে তারা। সপ্তাহান্তে এই করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও তিনটি ঋণের কিস্তি দিতে রীতিমত হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদেরকে। অটো-রিক্সাটি উদ্ধার না হওয়ায় হতাশা ব্যক্ত করে লতিফ খান জানান, ‘বর্তমানে স্ত্রী ও ছোট দুই কন্যা সন্তানকে নিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছি। সপ্তাহ ঘুরলেও তিনটি ঋণের কিস্তি দিতে হিমশীম খাচ্ছি। একদিকে ছেলে মৃত্যুর শোক, অন্যদিকে আয়ের উৎস্য অটোরিক্সা এখনো উদ্ধার না হওয়ায় তারা অর্থাভাবে ভুগছেন। এমতাবস্থায় তারা দ্রুত খুনিদের চিহ্নিত করাসহ তাদের আটক এবং তাদের অটোরিক্সাটি উদ্ধারে করে তাদের কাছে ফিরিয়ে দেয়ার আবেদন করেন।
উল্লেখ্য, গত ১ এপ্রিল উপজেলার গোবিন্দপুর দক্ষিণ ইউনিয়নের লামচর গ্রামের কালী মন্দিরের পাশে জনৈক শিপন দাসের পরিত্যক্ত ঘর থেকে ফয়েজ খানের বিকৃত লাশটি উদ্ধার করে ফরিদগঞ্জ থানা পুলিশ। ঐ রাতেই ফয়েজ খানের পিতা লতিফ খান বাদী হয়ে অজ্ঞাত নামাদের আসামী করে ফরিদগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। ফয়েজ খান উপজেলার গোবিন্দপুর উত্তর ইউনিয়নের ধানুয়া গ্রামের লতিফ খানের একমাত্র ছেলে।
এর আগে ২৮ মার্চ সে তার অটোরিক্সাটি নিয়ে বাড়ী থেকে বের হওয়ার পর নিখোঁজ হয়। এর পরদিন তার বাবা ফরিদগঞ্জ থানায় একটি নিঁেখাজ ডায়েরী করেন। এরপর ১ এপ্রিল স্থান থেকে হাত-পা বাঁধা অর্ধগলিত ও বিকৃত লাশের সন্ধান পায় পুলিশ। পরে লাশ উদ্ধারের পর পরিবারের লোকজন তার পরিধেয় গেঞ্জি, প্যান্ট ও জুতা দেখে লাশটি ফয়েজের বলে সনাক্ত করেন।
এদিকে, লাশটি উদ্ধারের পর ফরিদগঞ্জ থানায় হত্যা মামলা দায়ের করা হলেও পুলিশের পাশাপাশি সিআইডি ও পিবিআই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে ছায়া তদন্ত শুরু করে করে। এরই একপর্যায়ে সিআইডি পুলিশ মোবাইল ফোন ট্রাকিং করে হত্যা কান্ডের সাথে জড়িত সন্দেহে পাশ^বর্তী হাইমচর উপজেলা থেকে বোরহান নামে এক যুবককে আটক করার পর মামলাটির তদন্তভার তারা গ্রহণ করে।
এব্যাপারে চাঁদপুরের সিআইডি পুলিশের পরিদর্শক আবু জাহের সরকার মুঠোফোনে জানান, ইতিমধ্যে আটককৃত যুবক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছে। সে তথ্য অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে পর্যবেক্ষণ করছি। সন্দেহভাজন জড়িতরা গা ঢাকা দিয়ে বিভিন্ন স্থানে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। তবে তাদেরকে আটক করার জন্য অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এছাড়া নিরপরাধ কোন ব্যক্তি যাতে হয়রানির শিকার না হয় সে বিষয়টি মাথায় নিয়েই তদন্ত অব্যাহত রয়েছে। আশা করছি দ্রুতই হত্যা রহস্য উন্মোচন করতে সক্ষম হবো।
সম্পাদক ও প্রকাশক: মুনছুর আহমেদ বিপ্লব, মোবাইল: ০১৬১৫৩৩৪৩৭৩, ইমেইল: manobkhabornews@gmail.com