বিশেষ প্রতিনিধি :
বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজারের বালিয়াড়িতে বিশাল আকারের বাঁধ তৈরি করা হচ্ছে। এ বাঁধের ফলে দ্বিখণ্ডিত হচ্ছে সৈকতের বালিয়াড়ি। এতে রাক্ষুসে আচরণ করে ক্রমে ভেঙে তীরের দিকে আসছে সমুদ্র। এ ভাঙন অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে স্বপ্নের মেরিন ড্রাইভ সড়ক তলিয়ে যেতে পারে বলে মনে করছেন পরিবেশবিদরা।
এ নিয়ে প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেছে পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠন। বাঁধ নির্মাণ বন্ধ করতে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করেছে সংগঠনগুলো।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কক্সবাজারের সভাপতি ও প্রবীণ সাংবাদিক ফজলুল কাদের চৌধুরী বলেন, গত দুই সপ্তাহ ধরে ইনানি রয়েল টিউলিপ হোটেলের পশ্চিম পাশে সৈকত থেকে বালু নিয়ে জিও ব্যাগ ভর্তি করে একটি বাঁধ নির্মাণ প্রক্রিয়া শুরু হয়। ইসিএ এলাকায় এমন কাণ্ড নজরে আসার পর কক্সবাজার জেলা প্রশাসন, পরিবেশ অধিদফতর এবং কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে এ বাঁধ নির্মাণের বিষয়ে কোনো সঠিক তথ্য মেলেনি। অথচ কক্সবাজারসহ দেশের পরিবেশ সঙ্কটাপন্ন এলাকায় কোনো স্থাপনা বা বাঁধ নির্মাণ আইনত অবৈধ। ইসিএ এলাকা হওয়ার পরও পরিবেশ অধিদফতরসহ সংশ্লিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠান বাঁধ নির্মাণ বন্ধে এগিয়ে আসেনি। আমরা বাঁধ নির্মাণস্থলে গিয়ে মানববন্ধন-পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছি।
এদিকে বিষয়টি নজরে আসার পর মঙ্গলবার (৬ অক্টোবর) দুপুরে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ হল রুমে বৈঠক হয়। বৈঠকে স্থানীয় সংসদ সদস্য সাইমুম সরওয়ার কমল, কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান লে. কর্নেল (অব.) ফোরকান আহমেদ, জেলা জাসদ সভাপতি নাঈমুল হক চৌধুরী, মোহাম্মদ হোসেন মাসু, নৌবাহিনীর চট্টগ্রাম অঞ্চলের ক্যাপ্টেন শাহ আলমসহ বিশেষ গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধি, পরিবেশ অধিদফতর কক্সবাজারের সহকারী পরিচালক সংযুক্তা দাশগুপ্তা, রাজনৈতিক ও পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
বৈঠকে নৌবাহিনীর প্রতিনিধি ক্যাপ্টেন শাহ আলম বলেন, ২০২১ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর পক্ষ থেকে একটি আন্তর্জাতিক নৌমহড়া আয়োজনের প্রক্রিয়া চলছে। সেখানে প্রায় ৩৫টি দেশের নৌবাহিনীর সদস্যরা অংশ নেবেন। বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী কিংবা রাষ্ট্রপতি ওই নৌমহড়া উদ্বোধন করে কুচকাওয়াজে সালাম গ্রহণ করার কথা রয়েছে। মহড়ায় অংশ নেয়া জাহাজে যেতে ইনানি সৈকত এলাকায় নৌবাহিনীর পক্ষ থেকে একটি জেটি নির্মাণ করা হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী জেটি নির্মাণের অনুমোদন দিয়েছেন উল্লেখ করে ক্যাপ্টেন শাহ আলম বলেন, জেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট সব দফতরে অনুমতির জন্য আবেদন করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় প্রোগ্রাম হওয়ায় আশা করছি সংশ্লিষ্ট সব দফতর অনুমতি দেবে। সেটি মাথায় রেখেই কাজ অব্যাহত রাখা হয়েছে।
বৈঠকে পরিবেশবাদী নেতাদের পক্ষে জেলা জাসদ সভাপতি নাঈমুল হক চৌধুরী বলেন, আমরা জানতে পেরেছি চট্টগ্রামের একটি কোম্পানি ২০০ কোটি টাকা ইনভেস্টে সেন্টমার্টিনে পর্যটকবাহী জাহাজ নামাবেন। এর পেছনে সরকারের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও বর্তমানে কর্মরত অনেকে রয়েছেন। নৌবাহিনীকে সামনে দিয়ে জেটিটি নির্মাণের পর সেই কোম্পানি এটি স্থায়ীভাবে ব্যবহারের ফন্দি আঁটছেন।
কিন্তু জেলা প্রশাসন বা বিধিবদ্ধ কোনো সংস্থা ইসিএ ঘোষিত এলাকায় বাঁধ নির্মাণের অনুমতি দিতে পারে না। উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকার পরও এমন কাজ আইনের প্রতি অবমাননার শামিল। জিও ব্যাগের বালু ভরে বাঁধ নির্মাণ করতে গিয়ে বাঁধের উভয় পাশে পুকুরের মতো বানিয়ে ফেলা হয়েছে। আমরা সরকারের বিরোধী না, তবে আইন মেনে সৈকতের অখণ্ডতা রক্ষা করে জেটি নির্মাণ হোক সেটিই আমাদের দাবি।
বৈঠকে পরিবেশ অধিদফতরের কক্সবাজারের সহকারী পরিচালক সংযুক্তা দাশগুপ্তা বলেন, পরিবেশ আইনে ইসিএ এলাকায় অবকাঠামো ও বাঁধ নির্মাণে বাধা রয়েছে। প্রতিবেশ সঙ্কটাপন্ন এলাকা রক্ষা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। ইনানি সৈকতে বাঁধ নির্মাণে কাউকে অনুমোদন দেয়া হয়নি।
কক্সবাজারের বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠনের নেতারা সৈকতকে দ্বিখণ্ডিত করার প্রক্রিয়া বন্ধে কক্সবাজার সদর-রামু আসনের সংসদ সদস্য সাইমুম সরওয়ার কমলের সহযোগিতা চাইলে তিনি মঙ্গলবার (৬ অক্টোবর) দুপুরের পর ইনারি রয়েল টিউলিপ হোটেল এলাকায় নির্মাণাধীন বাঁধ পরিদর্শনে যান। এ সময় নৌবাহিনীর কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত ছিলেন।
পরিদর্শন শেষে সংসদ সদস্য সাইমুম সরওয়ার কমল বলেন, যেহেতু কক্সবাজার একটি ইসিএ এলাকা, সেহেতু সৈকতে বালুর রাস্তা তৈরি হলে সমুদ্র রাক্ষুসে রূপ ধারণ করতে পারে। এতে ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের মেরিন ড্রাইভ সড়কটিও। মেরিন ড্রাইভ রক্ষা এবং আন্তর্জাতিক নৌমহড়া সম্পন্ন করতে উখিয়া এবং রামুর সংযোগস্থল সোনারপাড়া রেজুখাল মোহনাটি ব্যবহার করা যেতে পারে।
এর আগেও ওই মোহনায় বড় জাহাজ নোঙর করার সক্ষমতা প্রমাণ হয়েছে। একটু ড্রেজিং করা হলে সেখানে একটি স্থায়ী নৌঘাঁটি ও জেটি নির্মাণ করা গেলে তা ব্যবহার করে সেন্টমার্টিনগামী জাহাজগুলো যাত্রী নিয়ে এখান থেকে চলাচল করতে পারবে। বিষয়টি বিবেচনায় নিতে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আমি কথা বলবো।
কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান লে. কর্নেল (অব.) ফোরকান আহমদ বলেন, রাষ্ট্রীয় আয়োজন আইনের ভেতর থেকেই করা বাঞ্ছনীয়। আইনে বাধা থাকলে রাষ্ট্রের কোনো বিভাগ চাইলেও তার অনুমতি দিতে পারে না। কিন্তু সরকারি প্রোগ্রাম বন্ধ রাখাও অসম্ভব। বিতর্ক এড়াতে বিকল্প পথ অবলম্বন করতে হবে।