অ্যাডভোকেট মো. আব্বাস উদ্দিন :
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন সেক্টর-২ এর অধীন সাব-সেক্টর-২, চাঁদপুরের অন্তর্গত ফরিদগঞ্জ উপজেলার মুক্তিযোদ্ধাদের নতুন তালিকা কতটুকু সঠিক, বাস্তবতার নীরিখে তা পুন:বিবেচনার দাবী রাখে। স্মৃতিপটে সেদিনের দৃশ্যাবলী যখন ভেসে ওঠে, তখন বুক ফেটে বেরিয়ে আসে দীর্ঘশ্বাস। তৎকালীন বেঙ্গল রেজিমেন্টের ছুটি ভোগরত হাবিলদার আব্দুল মান্নান (যিনি এলাকা মুন্নাফ নামে পরিচিত) এবং নায়েক আব্দুল মতিন যাঁরা জাতির পিতার ৭ই মার্চের ভাষণের মমার্থ অনুধাবন করে আমাদের মতো এলাকার যুবক শ্রেণীকে একত্রিত করে প্রশিক্ষন শুরু করেন। আমাদের ১৬ নং দক্ষিন রুপসা ইউনিয়নের প্রখ্যাত আওয়ামী লীগের রাজনীতিবিদ আইয়ুব আলী খানের পরামর্শক্রমে খাঁন সাহেবদের বাড়ীর শাহজাহান খান এবং ৪ জন তৎকালীন ছুটি ভোগরত ইপি আর ও মিলিটারী পুলিশ বিভাগের সদস্য সহ আমাদের ৫০ জনের একটি প্রশিক্ষিত ট্রুপস দাঁড় করান। আমাদের প্রশিক্ষন দেয়া হয় থ্রি নট থ্রি রাইফেল, শর্ট মেশিনগান এবং ৩৬ গ্র্যানেডের উপর। তাছাড়া বিভিন্ন বিস্ফোরক যথা ডিনামইটের উপর।
কৌশলে রাজাকারের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া রাইফেল এবং বুলেট দিয়েই আমাদের যাত্রা শুরু। ঢাকা হতে চট্রগ্রামের স্থলপথ ভারত সীমান্ত ঁেঘষা বিধায় হানাদার বাহিনী ঢাকা চাঁদপুরের নৌ বন্দর ব্যবহার করতো এবং চাঁদপুর থেকে ফরিদগঞ্জ-রায়পুর-চৌমুহনি-ফেনী হয়ে চট্রগ্রাম। একটি কথা না বলেলই নয়-একটি চলমান যুদ্ধের বিজয় নির্ভর করে তার নিরাপদ সরবরাহ ব্যবস্থা তথা সরবরাহ লাইনের উপর ।
স্মরণযোগ্য যে যুদ্ধ চলাকালীন যুদ্ধক্ষেত্রের বাস্তব অভিজ্ঞতা ছাড়া যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী এবং তাদের অবদানের মুল্যায়ন করা সম্ভব নয়। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধকালীন মিত্র পক্ষ তথা মার্কিন যুক্তরাষ্টে জেনারেল ম্যাক আর্থার যিনি ইস্টার্ন সেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন - তিনি বলেছিলেন “যুদ্ধক্ষেত্রের বাস্তব অভিজ্ঞতা ছাড়া-যুদ্ধের ইাতহাস রচনা এবং যোদ্ধাদের অবদান নির্ণয় করা কখন ও সম্ভব নয়”।
মোদ্দা কথা হল আমাদের মুক্তিযোদ্ধাগণ মোটামুটি ৩টি বাহিনীতে বিভক্ত ছিলেন, যদিও উদ্দেশ্য একটাই দেশকে শুত্রুমুক্ত করা অর্থাৎ স্বাধীন করা। যুদ্ধ শেষে যখন মুক্তিযোদ্ধাদের পরবর্তী যাঁচাই বাছাই শুরু হয় উচিত ছিল যে এলকার দায়িত্বে যিনি কমান্ডার বা সহকারী কমান্ডার ছিলেন, নির্বাচনী বোর্ডে তাদেরকে রাখা। এখন দেখা যাচ্ছে যারা যুদ্ধ শেষে বা পরে দেশে ফিরেছেন, তারাই যাচাঁই বাছাইয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত। দুঃখজনক হলেও সত্য রাজনৈতিক নেতাদের আত্মীয় অথবা অর্থের বিনিময়ে অনেকেই মুক্তিযোদ্ধোর স্বীকৃতি/সনদ পেয়েছেন। তাছাড়া রাজনৈতিক মত পার্থক্যের জন্যও অনেক সম্মুখ সারির মুক্তিযোদ্ধা যাচাঁই বাছাই বোর্ডে দুঃখজনক ভাবে বাদ পড়েছেন।
আমার জানামতে সর্বজন স্বীকৃত সাহেবগঞ্জের নজির আহমেদ, উভা রামপুরের মো. শাহ জাহান, প্রকৌশলী শহীদ আহমেদ যারা চাঁদপুর সাব সেক্টরের দায়িত্ব প্রাপ্ত সাব সেক্টর কমান্ডার ক্যাপ্ট (অব.) জহিরুল হক পাঠান ট্রুপসের সম্মুখ সারির যোদ্ধা তারও সনদ পাননি। ভাবতে অবাক লাগে আজকে যাদের কাছে উপস্থিত হতে হয়- যুদ্ধকালীন সময়ে এরা কোথায় ছিলেন ? কবে দেশে এসেছেন ? কোন যুদ্ধে পাক বাহিনীর মুখোমুখি হয়েছেন কিনা ? আজকে মত পার্থক্য থাকতে পারে কিন্তু হানাদার বাহিনী খতমে কি কোন মতপার্থক্য ছিলো ? কেন এমনটি হয় ? যাঁচাই বাছাইয়ে কেন রাজনৈতিক গন্ধ শোঁকা হয় ? যুদ্ধকালীন আমরা যারা একত্রে প্রশিক্ষন নিয়েছি, হানাদার বা তাদের দোসরদের আঘাত করেছি তাদের মাঝে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছেন........ তারা হলেন মকবুল আহমেদ, হাবিলদার আব্দুল মান্নান, নায়েক আব্দুল আজিজ সহ আরো অনেকে। স্মরণযোগ্য যে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতির পিতা স্কুলের মাধ্যমে আমাদেরকে একটি প্রভিশনাল সার্টিফিকেট একটি কম্বল, নগদ একশত টাকা মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে আমাদের প্রদান করেন। আমাদের ব্যাপারে জাতির পিতার সে স্বীকৃতিকে যারা অস্বীকার করেন তারাও কি মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষ শক্তি ?
আমার সাথে প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত এবং সহযোদ্ধা যারা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পান নি তাদের মধ্যে আমার সহোদর মরহুম ওসমান গনি, জনাব এসকান্দার আলী, জনাব আবদুস সাত্তার পাটওয়ারী, জনাব আব্দুল মান্নান, মরহুম আব্দুল মতিন পাটওয়ারী, জনাব আব্দুল করিম খন্দকার, জনাব আমিনুল ইসলাম খোকন, জনাব বেলায়েত হোসেন খান, জনাব শাহজাহান খান, জনাব খোরশেদ আলম পাটওয়ারী, লায়ন হারুনর রশিদ এমপি, আব্দুল মান্নান জমাদার প্রমুখ। এছাড়া অনেকের নাম এ মর্হুত্বে স্মরণে আসছেনা ।
গত বছর সরকার যাচাই বাছাই করে পুনরায় মুক্তিযোদ্ধাদের (বাদ পড়া) নাম পাঠানোর নির্দেশ দেওয়ার পর ফরিদগঞ্জে আবুল খায়ের পাটওয়ারীকে প্রধান করে একটি কমিটি ঘোষণা করে। দুঃখজনক হলেও সত্য দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভারত হতে প্রত্যাগত অনেকেই মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বিবেচিত হলেও যারা দেশের ভেতরে বীরত্বের সাথে লড়েছেন, তাদের অনেকেই বাদ পড়েছেন। আমরা যতদুর জানি জনাব আবুল খায়ের পাটওয়ারী যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ক্যাপ্ট(অব.) জহিরুল পাঠানের বাহনী ফরিদগঞ্জের উত্তরে গাজীপুর চান্দ্রা এলাকায় আসলে তিনি তাদের ভাত রান্না করতেন। যুদ্ধচলাকালীন তিনি কখনও ফরিদগঞ্জের দক্ষিনে আসেননি। সুতরাং এলাকার মুক্তিবাহিনীর সাথে তার পরিচয় না থাকারই কথা। তাছাড়া দেশ স্বাধীন হওয়ার ৪৯ বছর পর এখন মুক্তিযোদ্ধাদের গায়ে রাজনীতির গন্ধ শোঁকেন অথবা মা লক্ষ্মী তথা টাকা লেনদেনের কাজেই বেশী গুরুত্ব দেন বলে প্রচার। সঠিক মুক্তিযোদ্ধা যিনি যাঁচাই করবেন প্রথমে তাকেই অস্ত্র প্রশিক্ষন জানতে হবে। যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে হবে। তবেই তিনি যুদ্ধক্ষেত্রের সৈনিকদের চিনতে পারবেন। অন্যথায় নয়।
দেশ ও জনগনের জীবন রক্ষাকল্পে নিজের জীবন এবং আত্মীয় স্বজনের জীবনকে হানাদার বাহিনীর বন্দুকের মুখে সমার্পিত করে যে দিন ঘর থেকে বের হই, সেদিন তো ভাতার কথা ভাবিনি। বোধে জাগেনি রাজনীতি । লক্ষ্য ছিল দেশ জাতির স্বাধীনতা। সে দিনের জাতীয় ঐক্যই আমাদের স্বাধীনতা প্রাপ্তিকে সহজ করে তোলে।
আজ যারা মুক্তিযোদ্ধা নির্বাচনে রাজনীতি খোঁজেন আসলে এরাই পাক হনাদার বাহিনীর আর্দশিক অধঃস্তন পুরুষ। তাইতো আমাদের মাঝে এতো বিভেদ। আর বিভেদই হলো একটি জাতি রাষ্ট্রের বিপর্যয়ের প্রাণঘাতি জীবানু। ৭১ এর অবদানকে যারা স্বীকার করতে চায় না তারাই প্রকৃত পক্ষে পাক হানাদার বাহিনীর সর্বশেষ সংস্করণ ।
লেখক পরিচিতি : মো. আব্বাস উদ্দিন, অ্যাডভোকেট ও ট্যাক্স কনসালটেন্ট , বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট।
সাবেক সভাপতি : ঢাকা ট্যাক্সেস বার এসোসিয়েশন।
সম্পাদক ও প্রকাশক: মুনছুর আহমেদ বিপ্লব, মোবাইল: ০১৬১৫৩৩৪৩৭৩, ইমেইল: manobkhabornews@gmail.com