মানব খবর ডেস্কঃ
** সুরক্ষা সামগ্রী ছাড়াই ২৩০ দাফন করেছেন
** মৃতের জানাজা ও দাফন-কাফনও করেন
** প্রতিদিন মৃত্যুভয় নিয়ে বাসায় যান
** আত্মীয়-স্বজন তো দূরে বউ-বাচ্চাও কাছে আসে না
** তাদের দিকে সবাই বাঁকা চোখে তাকায়
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের শুরু থেকে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের ১০টি কবরস্থানে ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী ছাড়াই ৪৬ জন কর্মী কবর খোঁড়ার কাজ করছেন। মাঝে মধ্যে মৃতের জানাজা ও দাফন-কাফনের কাজও করেন তারা।
করোনার শুরু থেকে এ পর্যন্ত ২৩০ জনের কবর খুঁড়েছেন এসব কর্মী। সেই সঙ্গে দাফন-কাফনও করেছেন। এর মধ্যে করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা যাওয়া লাশ দাফনের সংখ্যা ১০১টি। ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী না থাকায় কবর খোঁড়া ও লাশ দাফন-কাফন শেষে মৃত্যুভয় নিয়ে প্রতিদিন বাসায় যান তারা। এ নিয়ে চরম আতঙ্কে রয়েছেন এসব কর্মী। তাদের দেয়া হয়নি কোনো সুরক্ষা সামগ্রী।
এসব বিষয়ে কথা হয় আব্দুস সামাদের সঙ্গে। তার বাসা ভাটিকাশর গোরস্থান এলাকায়। তার এক ছেলে ও এক মেয়ে। ছেলের বয়স নয় আর মেয়ের বয়স তিন বছর। ১৮ বছর ধরে কবর খোঁড়ার কাজ করেন সামাদ। এত বছর কবর খুঁড়ে অনেক অভিজ্ঞতা হয়েছে তার। হয়েছেন অনেক করুণ ঘটনার সাক্ষী।
পরিবারের খোঁজখবর নেয়ার ফাঁকে কথা হয় করোনা পরিস্থিতি নিয়ে। করোনা মহামারির সময় কেমন যাচ্ছে জিজ্ঞেস করতেই সামাদের চোখ ভারী হয়ে ওঠে। বন্ধ হয়ে যায় কথা। কিছুক্ষণ মাটির দিকে তাকিয়ে বড় একটা নিশ্বাস ফেলেন সামাদ। বুঝতে বাকি নেই মনের ভেতর চাপা কষ্ট তার। হয়তো কখনও কাউকে বলতে পারেননি অথবা কেউ জানতে চায়নি তার কষ্টের কথা।
কিছুক্ষণ পর ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে সামাদ বলেন, করোনার আগের সময়টাতে ভয় পেতাম না। করোনা শুরুর পরও মনে ভয় কাজ করেনি। করোনায় যখন মানুষের মৃত্যু শুরু হলো তখন কিছুটা ভয় পেয়ে যাই। এরপর দিনে দিনে যখন মৃত্যুর সংখ্যা বাড়তে শুরু করল তখন নিজেকে অসহায় ভাবতে শুরু করি। এখন পুরোপুরি মৃত্যুভয় কাজ করে মনে। কখন মরে যাই তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
‘কারণ স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী ছাড়াই কবর খুঁড়তে হয় আমাদের। যখন শুনি করোনায় মারা যাওয়া লাশ নিয়ে আসা হয়েছে তখন ভয় পাই। কবর খোঁড়ার হাত আর চলে না। মৃত্যুভয়ে থেমে যায় কবর খোঁড়া। এরপর মনকে সান্ত্বনা দিয়ে বলি, মরতে তো হবেই। সবাই তো মানুষ। একদিন সবাইকে কবরেই যেতে হবে। এই ভেবেই আবার শুরু করি কবর খোঁড়া’ বলছিলেন সামাদ।
এসব কথা বলার সময় সামাদের পাশে বসা ছিলেন ইমরান। তিনিও কবর খোঁড়েন। তার বাসাও ভাটিকাশর গোরস্থান এলাকায়। তার দুই ছেলে। বড় ছেলের বয়স ১০ আর ছোট ছেলের চার। ইমরান ভাটিকাশর গোরস্থান এলাকায় পাঁচ বছর ধরে কবর খুঁড়ছেন। এর আগে ১৫ বছর বিভিন্ন স্থানে কবর খুঁড়েছেন তিনি।
কবর খোঁড়ার অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে ইমরান বলেন, কবর খুঁড়তে ব্যাপক সাহসের প্রয়োজন। আমরা কবর খোঁড়ার জন্য সবসময় প্রস্তুত। করোনার সময় অনেকের কবর খুঁড়েছি। তবে চারজনের কবর খুঁড়তে গিয়ে নিজেকে অসহায় লেগেছে। মনে হয়েছে পৃথিবীতে কেউ কারও আপন নই।
তিনি বলেন, করোনায় মারা যাওয়া চারজনের লাশ নিয়ে আসা হয়েছিল। ভয়ে ভয়ে তাদের কবর খুঁড়েছি। লাশের সঙ্গে ছিল না কেউ। মনে হলো তাদের আত্মীয়-স্বজন কেউ নেই। আহারে মানুষের জীবন! যে ব্যক্তি ছিলেন পরিবারের সবার প্রিয় আজ তার লাশের সঙ্গে কেউ নেই। দাফনের পরও কেউ তাদের দেখতে আসে না। এতটা নির্মম হয়ে গেছে মানুষ।
ইমরানের কথা শেষ না হতেই তার পাশে এসে বসেন আব্দুস সালাম। বয়স তার ৫৫। তিনি কানে কম শোনেন বললেন ইমরান।
কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই নিজ থেকে আব্দুস সালাম বলতে শুরু করলেন, ‘জীবনডা কবর খোঁড়ার কামেই শেষ করছি। সমাজরে কি দিলাম; আর কি পাইলাম। কহনো চিন্তা করলাম না। বুকটা ফাইটা যায়। কইমু কারে। কবর খোঁড়ার কাম কইরা পাঁচ হাজার ট্যাহা পাই। এইডা দিয়া চা আর পান খাইয়াই শেষ কইরা ফালাই। আমাদের সংসার কেমনে চলে হেইডা কেউই ভাবে না। আমার দুইডা ছেলে। বউ -বাচ্চার মুহে ভাত না দিবার পারলে ভালা চোহে দেহে না। আমগর বেতনডাও বাড়ে না।’
তাদের কাছ থেকে ফিরে আসার সময় দেখা হলো আরেকজন কবর খোঁড়া লোকের সঙ্গে। নাম জিজ্ঞেস করতেই বললেন আব্দুল কাদের লিটন। চড়পাড়া এলাকায় থাকেন। তারও দুই ছেলে।
তিনি বলেন, করোনা ছাড়াও স্বাভাবিকভাবে মারা যাওয়া ব্যক্তির কবর খুঁড়ে যখন রাস্তা দিয়ে বাড়ি যাই তখন একজন আরেকজনকে আঙুল দিয়ে ইশারা দিয়ে দূরে চলে যায়। আত্মীয়-স্বজন তো দূরের কথা বউ-বাচ্চাও কাছে আসে না। যেদিন করোনায় মারা যাওয়া ব্যক্তির কবর খুঁড়ে বাসায় যাই সেদিন মানুষের আচরণ দেখলে কষ্টে বুকটা ফেটে যায়। কাদের জন্য আমরা এসব করছি! সবাই বাঁকা চোখে আমাদের দিকে তাকায়।
ভাটিকাশর গোরস্থানের প্রধান খাদেম হেলাল উদ্দিন বলেন, এ পর্যন্ত চারজন করোনায় মৃত ব্যক্তিকে এখানে দাফন করা হয়েছে। গোরস্থানে চারজন কবর খোঁড়ার কাজ করেন। আমি এখানেই সবসময় থাকি। প্রথম প্রথম ভয় করলেও এখন আর করে না। রাতে যখন বাসায় যাই তখন ছেলে-মেয়েদের কাছে আসতে দেই না। কারণ আমরা যেখানে কাজ করি সেখানে করোনা রোগীকে দাফন করা হয়। একদিন তো মরতেই হবে। যারা কবর খোঁড়েন; সামাজিকভাবে দূরে না সরিয়ে তাদের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করা প্রয়োজন। করোনা পরিস্থিতিতে কবর খোঁড়া ব্যক্তিদের জন্য সরকারি সহায়তা প্রয়োজন।
করোনায় মৃত ব্যক্তিদের লাশের কাছে যায় না আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীরা। এ অবস্থায় করোনায় মৃত ব্যক্তির গোসল, দাফন-কাফন থেকে শুরু করে জানাজা পড়ান ইসলামিক ফাউন্ডেশন ও খিদমাতুল মাউতাল মুসলিমিনের সদস্যরা। ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশন এলাকায় করোনায় কেউ মারা গেলে ইসলামী নিয়ম মেনে দাফন-কাফন করেন তারা।
খিদমাতুল মাউতাল মুসলিমিন ময়মনসিংহের প্রধান এমদাদুল বলেন, ইসলামিক ফাউন্ডেশন আর আমরা যৌথভাবে কাজ করছি। ইসলামের নিয়ম অনুসারে করোনায় মৃত ব্যক্তির গোসল, দাফন-কাফন ও জানাজা দিচ্ছি আমরা। এটি শুধু মানবিক কারণেই করছি। সব মুসলমান ভাই ভাই। আমরা সবাই মানুষ। একদিন সবাই মারা যাব। তাই করোনা মারা যাওয়া ব্যক্তিদের দাফন দেয়া আমাদের দায়িত্ব।
ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের খাদ্য ও স্যানিটারি কর্মকর্তা দীপক মজুমদার বলেন, সিটি করপোরেশন এলাকায় কেউ করোনায় মারা গেলে ভাটিকাশর গোরস্থানে দাফন দেয়া হয়। এ পর্যন্ত চারজন করোনায় মৃত ব্যক্তিকে দাফন করা হয়েছে সেখানে। পাশাপাশি শ্মশানে একজনের শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হয়েছে।
তিনি বলেন, করোনায় মৃত মুসলিম ব্যক্তির দাফন-কাফন ও গোসলের জন্য আলাদা টিম রয়েছে। তাদের ঝুঁকি বেশি। তাই তাদের পিপিই দেয়া হয়েছে। যারা কবর খোঁড়েন তাদেরও প্রথমে পিপিই দেয়া হয়েছে। তবে তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী দেয়া হবে হয়নি। পিপিই ও স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী দেয়া হবে তাদের।
সম্পাদক ও প্রকাশক: মুনছুর আহমেদ বিপ্লব, মোবাইল: ০১৬১৫৩৩৪৩৭৩, ইমেইল: manobkhabornews@gmail.com