নিজস্ব প্রতিবেদক :
শিক্ষা বিস্তারে চাঁদপুরের যে কজন মহৎপ্রাণ মানুষের অবদান উল্লেখযোগ্যভাবে স্মরণীয় তাঁদের মধ্যে অধ্যাপক জাকির হোসেন মজুমদার অন্যতম। তিনি শিক্ষানুরাগী পরিবারের সন্তান ছিলেন। তাঁর পরিবারের মাধ্যমে হাজীগঞ্জ উপজেলায় বেশ কয়েকটি বিদ্যানিকেতন প্রতিষ্ঠিত হয়। ছাত্রজীবন শেষে জাকির হোসেন মজুমদারও শিক্ষাবিস্তারে নিজেকে নিয়োজিত করেন। হাজীগঞ্জ উপজেলার বাতিঘর হাজীগঞ্জ ডিগ্রি কলেজ প্রতিষ্ঠায় তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।
অধ্যাপক জাকির হোসেন মজুমদারের জন্ম হাজীগঞ্জের রান্ধুনীমুড়া গ্রামের মজুমদার বাড়িতে। পিতা আলহাজ্ব সেকান্দর মজুমদার ও মা হালিমা খাতুনের ৬ ছেলেমেয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন পঞ্চম। ঐতিহ্যবাহী মজুমদার পরিবার বহু পূর্ব থেকেই শিক্ষানুরাগী ছিলো। তাদের প্রতিষ্ঠিত রান্ধুনীমুড়া বিদ্যালয়ে জাকির হোসেন মজুুমদার প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। এরপর তিনি হাজীগঞ্জ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। পরবর্তীতে চাঁদপুরের ডিএন স্কুল থেকে এসএসসি এবং ঢাকা কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ছিলেন। এ বিভাগ থেকে তিনি অনার্সর্ ও এমএ পাস করেন।
ছাত্রাবস্থায় জাকির হোসেন মজুমদার রাজনীতি সচেতন ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সক্রিয়ভাবে ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে তিনি সম্পৃক্ত ছিলেন। জাকির হোসেন মজুমদার ১৯৬৭-৬৮ সালের ঢাবির জিন্নাহ হল শাখা বর্তমানে সূর্যসেন হল ছাত্রলীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। ওই কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী। রাজনীতি সচেতন ছিলেন বলেই জাকির হোসেন মজুমদার সমাজ ও সাধারণ মানুষ নিয়ে ভাবতেন। তিনি কৈশোরে দেখেছেন হাজীগঞ্জে উচ্চ শিক্ষার জন্যে কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। ওইসময় কেবল চাঁদপুর মহকুমা সদর ও কুমিল্লা সদরে উচ্চ শিক্ষার জন্যে কলেজ ছিল। ফলে হাজীগঞ্জসহ অন্য উপজেলার শিক্ষার্থীদের সেখানে গিয়ে পড়তে হতো। কিন্তু অসহায়-অসচ্ছল শিক্ষার্থীদের পক্ষে চাঁদপুর বা কুমিল্লায় গিয়ে পড়ার সুযোগ হতো না। সেকারণে রাজনীতিতে উজ্জ্বল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও জাকির হোসেন মজুমদার পড়াশোনা শেষ করে ১৯৬৮ সালে হাজীগঞ্জে চলে আসেন। এসেই হাজীগঞ্জে একটি কলেজ প্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা শুরু করেন।
তার আগেও অনেকে হাজীগঞ্জে কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্যে উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু জমি প্রদানসহ নানা কারণে তা আর হয়ে উঠেনি। জাকির হোসেন মজুমদার জমি সংক্রান্ত সমস্যার কথা উপলব্ধি করে তিনি পরিবারের শরণাপন্ন হন। যেহেতু তাঁর বাবা-চাচাসহ অন্যরা পূর্ব থেকেই শিক্ষানুরাগী ছিলেন, তাই তাদের বুঝাতে দেরি হয়নি। জাকির হোসেন মজুমদারের অনুরোধে তাঁর পরিবার কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্যে জমি দিতে রাজি হয়। তাঁদের দেয়া জমির উপরে প্রতিষ্ঠিত হয় হাজীগঞ্জ ডিগ্রি কলেজ। কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্যে যারা জমি দিয়েছিলেন তারা হলেন : আলহাজ্ব সেকান্দর মিঞা মজুমদার, এসকান্দর মিঞা মজুমদার, আবদুল মতিন মজুমদার, সামছুল হক মজুমদার, নূরুল ইসলাম মজুমদার, আবুল খায়ের মজুমদার, আবুল কাশেম মজুমদার, তাফাজ্জাল হোসেন মজুমদার, দেলোয়ার হোসেন মজুমদার, আলী হোসেন মজুমদার ও জাকির হোসেন মজুমদার। তাঁরা কলেজ প্রতিষ্ঠার জন্যে কন্ডিশনাল গিফট হিসেবে ৫ একর জমি প্রদান করেন। কলেজের জমিসংক্রান্ত দলিলে এ দাতাগণের নাম উল্লেখ রয়েছে। দলিলে লেখা রয়েছে, '...আমরা দলিল দাতাগণ আমাদের পূূর্বপুরুষগণের আত্মার সদগতির উদ্দেশ্যে ও হাজীগঞ্জবাসীর কলেজ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বাস্তব রূপদানের জন্যে মহান উদ্দেশ্যে আমরা আমাদের নিম্নোক্ত সম্পত্তি হাজীগঞ্জ কলেজ কমিটি বরাবরে দান করিয়া লিখিয়া দিতেছি...।' জাকির হোসেন মজুমদারের পরিবার ১৯৬৯ সালের ২২ জুলাই এ দলিল করেন।
পরবর্তীতে এ জমির উপরেই প্রতিষ্ঠিত হয় হাজীগঞ্জ কলেজ। জাকির হোসেন মজুমদার ছাড়াও তৎকালীন স্থানীয় প্রবীণ সমাজসেবক, রাজনীতিবিদ, প্রশাসনিক কর্মকর্তাবৃন্দও এ কলেজ প্রতিষ্ঠায় অর্থবহ ও সংগঠকের ভূমিকা রাখেন। প্রথমে পাঠদানের জন্যে লম্বা একটি টিনশেড চৌচালা ঘর করা হয়। কলেজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন তৎকালীন মহকুমা প্রশাসকসহ স্থানীয় প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। ১৯৭০ সাল থেকে পাঠদান কার্যক্রম শুরু করা হয়। প্রতিষ্ঠার পর প্রতিষ্ঠানটির দায়িত্ব নেয়ার মতো উপযুক্ত শিক্ষাগত যোগ্যতাসম্পন্ন কাউকে পাওয়া যাচ্ছিল না। যারা ছিলো তারা কেউ নতুন প্রতিষ্ঠিত এ কলেজের দায়িত্ব নিতে চাননি। তখন সদ্য এমএ পাস করা জাকির হোসেন মজুমদারই কলেজের হাল ধরেন। এলাকাবাসী অনুরোধ করলে ঢাকার সম্ভাবনাময় রাজনীতি ও চাকুরি রেখে তিনি হাজীগঞ্জ কলেজের অধ্যক্ষের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিসেবে তিনি ১৯৭২ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন।
অধ্যাপক জাকির হোসেন মজুদারের উত্তরাধিকার হিসেবে তাঁর সন্তান মাহমুদ আহমেদ মিঠু বর্তমানে হাজীগঞ্জ ডিগ্রি কলেজের পরিচালনা পর্ষদের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে কাজ করছেন। তিনি বলেন, আমার বাবা হাজীগঞ্জ ও আশেপাশের সাধারণ মানুষের উচ্চশিক্ষার জন্যে তিনি বর্ণাঢ্য রাজনীতি ও উজ্জ্বল সম্ভাবনাকে রেখে ঢাকা থেকে চলে আসেন। হাজীগঞ্জ কলেজ প্রতিষ্ঠায় তিনি প্রধান ভূমিকা রাখেন। প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষও তিনি ছিলেন। তিনি কলেজ থেকে কোনো বেতন নিতেন না। তিনি সবসময় বলতেন, এ অঞ্চলের মানুষ উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হলে সমাজের উন্নয়ন ঘটবে। তারা ভালো চাকুরি পাবে এবং জীবনমানের উন্নয়ন ঘটবে। হাজীগঞ্জের মানুষও বাবার এই অকৃত্রিম শিক্ষানুরাগের প্রতিদান ভালোবাসা ও শ্রদ্ধার মাধ্যমে দিয়েছেন।
একসময় পারিবারিক কারণে জাকির হোসেন মজুমদার চাঁদপুর শহরে চলে আসেন। তখন তিনি মহিলা কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে যোগদান করেন। তিনি ভালো কবিতা লিখতেন। চাঁদপুরে তাঁর কবি হিসেবে খ্যাতি ছিলো। অধ্যাপনার পাশাপাশি জাকির হোসেন মজুমদার চাঁদপুরের বিভিন্ন সাহিত্য ও সংস্কৃতি সংগঠনের সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন। তিনি সাহিত্য একাডেমী চাঁদপুরের প্রতিষ্ঠাকালীন সহকারী মহাপরিচালক ছিলেন। চাঁদপুর থাকলেও হাজীগঞ্জ কলেজের সাথে ছিল তার নিবিড় যোগাযোগ। তিনি কলেজটির নিয়মিত খোঁজখবর নিতেন। ২০০০ সালের ৭ মে চাঁদপুর সরকারি কলেজে চাকুরিরত অবস্থায় এই কীর্তিমান শিক্ষানুরাগী মৃত্যুবরণ করেন।
অধ্যাপক জাকির হোসেন মজুমদার দশ-পনেরজন শিক্ষার্থী নিয়ে যে কলেজটির যাত্রা শুরু করেছিলেন সে কলেজটি আজ শত শত শিক্ষার্থীর পদচারণায় মুখরিত। ১৯৮২ সালে সমাজসেবক নন্দলাল সাহা নতুন করে কলেজটির জন্যে ১.৩৩ একর জমি প্রদান করেন। ফলে এখন মোট ৬.৩৩ একর জায়গার উপর দাঁড়িয়ে থাকা এ কলেজটি হাজীগঞ্জ ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের শিক্ষা বিস্তারে কাজ করে যাচ্ছে।
মানুষ মরে গেলেও তাঁর কাজ বেঁচে থাকে। অধ্যাপক জাকির হোসেন মজুমদার দুই দশক পূর্বে মৃত্যুবরণ করলেও তাঁকে আজও চাঁদপুুর ও হাজীগঞ্জবাসী বিনম্র শ্রদ্ধায় স্মরণ করে।
সম্পাদক ও প্রকাশক: মুনছুর আহমেদ বিপ্লব, মোবাইল: ০১৬১৫৩৩৪৩৭৩, ইমেইল: manobkhabornews@gmail.com