জীবনে টিকে থাকার জন্য কাজের কোনো বিকল্প নেই। কাজ করতে হলে শ্রম দিতে হয়, ঘাম ঝরাতে হয়। সেটা হোক কায়িক কিংবা মানসিক। যিনি শ্রম দেন তিনিই শ্রমিক। আর এ শ্রমিকদের জন্যই একটা দিন পহেলা মে। আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস। সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও দিবসটি যথাযোগ্য মর্যাদায় পালনে নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘শ্রমিক-মালিক ঐক্য গড়ি, উন্নয়নের শপথ করি।’
প্রতি বছর যখনই মে দিবস আসে তখন সচেতন মানুষের মাঝে ‘শ্রমিক অনুভূতি’ জাগ্রত হয়। কারণ এ দিনটি শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার দিন, বিশ্বব্যাপী শ্রমজীবী মানুষের আন্দোলন-সংগ্রামে অনুপ্রেরণার উৎসের দিন, মালিক-শ্রমিক সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা আর শ্রমিকদের শোষণ-বঞ্চনার অবসান ঘটার স্বপ্ন দেখারও দিন। এসবকিছুকে যেন মনে করিয়ে দেয় মে দিবস। সময়ের ভেলায় ভেসে বছর ঘুরে এবারো ফিরে এসেছে শ্রমিক দিবস।
মে দিবসের প্রেক্ষাপট: শ্রমের ন্যায্য অধিকার আদায়ে ১৩৩ বছর আগে শোষণ বঞ্চনার বিরুদ্ধে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিলেন শ্রমজীবীরা। ১৮৮৬ সালের এ দিন আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে যুক্তরাষ্ট্রের সব শিল্পাঞ্চলে ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিলেন শ্রমিকরা। সে ডাকে শিকাগো শহরের তিন লাখ শ্রমিক কাজ বন্ধ রাখেন।
শ্রমিক সমাবেশকে ঘিরে শিকাগো শহরের হে মার্কেট রূপ নেয় লাখো শ্রমিকদের জনসমুদ্রে। সেদিন লাখো শ্রমিক লাল ঝান্ডা হাতে সমবেত হন সেখানে। বিক্ষোভের এক পর্যায়ে পুলিশ শ্রমিকদের ওপর নির্বিচারে গুলি চালালে ১১ শ্রমিক প্রাণ হারান। ওই ঘটনার রেশ ছড়িয়ে পড়ে গোটা বিশ্বে। গড়ে ওঠে শ্রমিক-জনতার বৃহত্তর ঐক্য। অবশেষে তীব্র আন্দোলনের মুখে শ্রমিকদের দৈনিক আটঘণ্টা কাজের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয় যুক্তরাষ্ট্র সরকার।
পরে ১৮৮৯ সালের ১৪ জুলাই প্যারিসে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে শিকাগোর রক্তঝরা অর্জনকে স্বীকৃতি দেয়া হয়। ওই ঘটনার স্মারক হিসেবে ১ মে ‘আন্তর্জাতিক শ্রমিক সংহতি দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ১৯৭২ সালে মে দিবসকে বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালনের স্বীকৃতি দেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এরপর থেকে যথাযোগ্য মর্যাদায় মে দিবস পালিত হয়ে আসছে।
রাষ্ট্রপতি-প্রধানমন্ত্রীর বাণী: যথাযোগ্য মর্যাদায় মে দিবস পালনের আহ্বান জানিয়ে পৃথক পৃথক বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী মহান মে দিবস ২০১৯-এর সার্বিক সাফল্য কামনা করেন।
বাণীতে রাষ্ট্রপতি শ্রমিকের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় ন্যায্য মজুরি, নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
পৃথক বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মে দিবসের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে পারস্পরিক সুসম্পর্ক বজায় রেখে শ্রমিক ও মালিকদের কলকারখানার উৎপাদন বৃদ্ধিতে নিবেদিত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
কর্মসূচি: আজ সরকারি ছুটি। সরকারি-বেসরকারি অফিস-আদালতের পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সব তফসিলি ব্যাংক ও কলকারখানা বন্ধ। বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারসহ বেসরকারি স্যাটেলাইট টেলিভিশন ও বেতারগুলো বিশেষ অনুষ্ঠানমালা সম্প্রচার করবে এবং সংবাদপত্রগুলোতে বিশেষ ক্রোড়পত্র ও নিবন্ধ প্রকাশ করা হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও অনেকে শ্রমিক দিবসের শুভেচ্ছা জানান। শ্রমিক দিবসের মূল চেতনা বাস্তবায়নের প্রত্যাশা করেন।
প্রতি বছরের মতো এবারো রাষ্ট্রীয়ভাবে মে দিবস উদযাপন উপলক্ষে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। সকাল ৭টায় মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে শ্রমভবনের সামনে থেকে বর্ণাঢ্য র্যালির আয়োজন করা হয়েছে। বিকেল ৪টায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। বাংলাদেশ শ্রমিক ফেডারেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে সকাল ১০টায় শ্রমিক সমাবেশ করবে। আগামী ২ মে বিকেল ৩টায় মে দিবস উপলক্ষে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জাতীয় প্রেসক্লাবে একটি সেমিনার অনুষ্ঠিত হবে।
এছাড়া দেশের বিভিন্ন জেলায় অবস্থিত শ্রম অধিদপ্তর এবং কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের উদ্যোগে বিভিন্ন কর্মসূচি পালিত হবে। মে দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল যেমন আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, বাংলাদেশ পোশাকশিল্প শ্রমিক ফেডারেশন, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে) ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) দুই অংশ, জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দল, বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র, বাংলাদেশ শ্রমিক ফেডারেশন, জাতীয় শ্রমিক জোটসহ বিভিন্ন সংগঠন নানা কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। সামাজিক, পেশাজীবী ও সাংস্কৃতিক সংগঠন নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। এসব কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে র্যালি, আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।